কুড়িগ্রামে জুন থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত টানা পাঁচ দফা বন্যায় চুরমার হয়েছে কৃষকের স্বপ্ন। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জেলার হাজার হাজার কৃষক। প্রথম থেকে তৃতীয় দফার বন্যায় কৃষকের ইরি ধান, আউশ ধান, পাট, ভুট্টা, কাউন, চিনা, তিল ও মরিচসহ সবজি জাতীয় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এ সময় অর্থকরী ফসলের পরিমাণ ছিলো বেশী।
জেলায় ১৭ হাজার ৫৫৬ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণরুপে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এর মধ্যে ১১ হাজার ৬৬২ হেক্টর জমির ফসল একেবারে পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। বন্যার পানি দেড়মাস স্থায়ী হওয়ার ফলে আমন আবাদের বীজতলাও পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী প্রথম থেকে তৃতীয় দফার বন্যায় আমন বীজতলা ১৪০৯ হেক্টর, আউস ধান ৫২১৭ হেক্টর, শাকসবজি ৯৫৩ হেক্টর, পাট ৯২৩৫ হেক্টর, তিল ৩০৫ হেক্টর, মরিচ ২০৫ হেক্টর, চিনা ১৪০ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে বন্যায় ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫৮জন কৃষক। এর মাঝে ২৭ হাজার ৭৬১ জন কৃষককে সবজি বীজ সহযোগিতা দেয় কৃষি বিভাগ।
এছাড়াও ১০৫টি কমিউনিটি বীজতলা, শতাধিক ভাসমান বীজতলা ও ১১২টি ট্রে বীজতলা প্রস্তুত করে আমন চারা দেয়া হয় কৃষকদের।
তৃতীয় দফা বন্যা শেষে কৃষি বিভাগের সহযোগিতা এবং নিজেদের উদ্যোগে আমন চাষ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে জেলার কৃষক। তবে সেপ্টেম্বরে দুই দফা বন্যা আর ভারি বৃষ্টিতে সে স্বপ্ন ভেসে যায় তাদের। উঠতি আমন ধান পানিতে তলিয়ে পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। দফায় দফায় বন্যার কারণে ক্ষেতের ফসল হারিয়ে কৃষক এখন দিশেহারা। সব ধরণের ফসল নষ্ট হওয়ায় ব্যপক লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। সরকারিভাবে পুনর্বাসন ও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার দাবি কৃষকের থাকলেও সবার কাছে পৌঁছবে না প্রণোদনা।
ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের পূর্বধনিরাম গ্রামের ধান চাষী নুর ইসলাম ও আব্দুল ফাতেল জানান, তিন-তিনবার ধান গাড়নু, তিনোবার বানে খায়া গেইল। এ্যালা কি খায়া বাঁচমো বাহে। চাষী নুর ইসলাম জানান, বানের পনিত ক্ষেতের সব ধান শেষ। হামারগুলার দু:খের শ্যাষ নাই। সাথে গরুগুল্যারো খোয়ার পোয়ালও (খড়) নাই। ধার-দেনা করি চাইর বিঘা আমন ধান করছিনু সেগুইলাও পঁচি গেইল, এখন মরণ ছাড়া আর কিছু বাকি নাই।
নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাষ ইউনিয়নের কৃষানী মাজিয়া বেগম জানান, প্রথম দফার বন্যায় ৪ বিঘা কাউনের আবাদ নষ্ট হয়ে যায় তার। পরবর্তীতে চড়া দামের আমন চারা কিনে ২ বিঘা জমি চাষ করেন তিনি। সেগুলোও এই বন্যায় পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী দিনগুলো কিভাবে চলবে সেই চিন্তায় নির্ঘুম রাতকাটে তার। একই উপজেলার কচাকাটা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল বাতেন জানান, প্রথম দফায় ১৫ বিঘা পাট একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। সেই ক্ষেতে কিছুটা আমন চাষ করেছিলো তাও পানিতে তলিয়ে নষ্ট হওয়ার পথে।
কুড়িগ্রাম কৃষিবিভাগ জানায়, এ মৌসুমে ১ লাখ ১৫হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে আমন চাষ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৯ হেক্টর জমিতে। চাল উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন। তবে বন্যায় আমনের ক্ষতি হওয়ায় এ লক্ষমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম দফার বন্যায় নিম্নাঞ্চল এবং চরাঞ্চলের উঠতি আমন ধান তলিয়ে পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া অধিক বৃষ্টিপাতে নষ্ট হয়ে যায় শীতকালীন সবজির আবাদ।
কুড়িগ্রাম কৃষি বিভাগের তথ্যমতে অতি বৃষ্টি এবং শেষ দফার বন্যায় জেলায় প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর আবাদী জমি ডুবে যায়। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর উঠতি আমন ধান পানিতে তলিয়ে যায়। তলিয়ে যাওয়া বেশীর ভাগ আমন ধান পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এসব জমির আবাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিরুপনের চেষ্টা চলছে। কুড়িগ্রামের খামারবাড়ির উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ শামসুদ্দিন মিঞা জানান, এখন পর্যন্ত শেষ দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য কোন প্রকার প্রণোদনা পাওয়া যায়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুতে মাঠ পর্যায় কাজ চলছে। তালিকা প্রণয়ন শেষে তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন