বিচারপতি মোহা. আব্দুস সালাম
স্বাধীন বাংলাদেশ, রাজনীতি, ইতিহাস সবই মানুষকে নিয়ে। বাংলাদেশে মুসলমান ও হিন্দু মানুষের দুটি প্রধান অংশ। এদেশে রাজনীতির বয়স হাজার বছরেরও বেশি যখন হযরত শাহ জালাল ও হযরত শাহ মাখদুম আসেন ইসলাম প্রচারের জন্য। ১২০৩ খৃ. থেকে ৫৫০ বছর মুসলমানরা শাসন করেন এদেশ- অবিভক্ত ভারত। তার আগে হিন্দু সেন রাজারা ১০৬ বছর এবং তার আগে বৌদ্ধ পাল রাজারা শাসন করেন ৩৪৭ বছর। ১৭৫৭ সালে স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহর পরাজয়ের মাধ্যমে মুসলমানরা রাজ্যসহ সর্বস্ব হারায় এবং বণিক ইংরেজ জাতি শাসক হওয়ার সুযোগ পায়। ১৮৫৭ সালে দিল্লীর শেষ মোঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ভারতে ইংরেজ রাজ সুপ্রতিষ্ঠিত হতে ১০০ বছর সময় লাগে। এর নব্বই বছর পরে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। বাংলাদেশকে ১৯০ বছর ইংরেজের গোলামি করতে হয়। ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংগ্রাম শুরু হয়, ইংরেজরা বলে এটা ছিল ‘সিপাহী বিদ্রোহ’। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিমলীগের জন্ম হয়। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পাস হয়। বাংলার নেতা এ কে ফজলুল হক ভারত বিভাগের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে জানুয়ারি মাসে সর্বদলীয় ওলামায়ে কেরামের ২২ দফা অগ্রাহ্য হয়। তার পর ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ আইন সভার ৩০০ আসনের নির্বাচন হয়। বাঙালি জাতির তদানীন্তন নেতা এ কে ফজলুল হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী জোট বিজয়ী হয়। ১৯৫৪ সালে জয়পুরহাট সম্মেলন হয়। “আওয়ামী মুসলীমলীগ” হতে ঐ সালে অসম্প্রদায়িক ‘আওয়ামী লীগ’ এর জন্ম হয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের কুশাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক আচরণ এবং Economic Disparity--এর কারণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য ৬ দফা আন্দোলনের ডাক দেন। এই ৬ দফা আন্দোলনের মধ্যে বাঙালি জাতির মুক্তির ও স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়। তদানীন্তন পাকিস্তানের সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হয় ও জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। আন্দোলনের চাপে ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। নির্বাচনের দাবিতে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলন শুরু হয়। ফলে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হন। আমি সে সময়ে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপনার পদ ছেড়ে বিচার বিভাগে মুনসেফ হিসাবে আদালতে কর্মরত ছিলাম। নির্বাচিত প্রতিনিধির পক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে সংলাপ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আইন সভার অধিবেশন স্থগিত করা হয়। ১৯৭১ সালে ১৯-২৩ মার্চ আলোচনা চলে। আলোচনা ব্যর্থ হয়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ইপিআর ওয়ারলেস মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইপিআরের সদস্য মাহতাব উদ্দিন ঐ বার্তা গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এম এ হান্নান চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে স্বাধীনতার বাণী ঘোষণা করেন মর্মে কাগজপত্রে পাওয়া যায়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জিত হয়।
১৯১৩ সালে বাঙালি কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পান। বিশ্বের মানুষ প্রথম বাঙালি ও বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে পারে। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬ নম্বর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় আমেরিকার নিউইয়র্কে। তার ৫ দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম এশীয় নেতা বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দেন এবং দ্বিতীয়বার সারা বিশ্ব চিনতে পারে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের । তখন জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন ড. কুর্টওয়াল্ড হেইম এবং সভাপতিত্ব করেন আলজিরিয়া মুক্তি সংগ্রামের নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আজিজ বুটে ফলিকা। তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষায় ভাষণ ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এদেশের মানুষ শত শত বছর ধরে (২১৪ বছর) সংগ্রাম করেছে শান্তির জন্য। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ছিল শান্তির জন্য। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহন বলেন, “খুব শক্তিশালী ভাষণ ছিল এটি”। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরনসিং এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকব মালিক খুব খুশি হয়ে জাতিসংঘে বক্তৃতা দেন। জাতিসংঘের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, “পৃথিবীর পার্লামেন্টে নতুন দেশ বাংলাদেশকে স্বাগতম”।
১৯৭৫ সালে মুহাম্মদ উল্লাহ (নোয়াখালী) বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পার্লামেন্টে আইন পাস করে deemed to be elected as President বিধান জারি করলে মুহাম্মদ উল্লাহ আপনা আপনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারিত হন এবং বঙ্গবন্ধু automatically deemed to have been elected as President মর্মে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সিভিল সোসাইটির বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মতে, রাষ্ট্রপতির বিশেষ নিরাপত্তাজনিত কারণে স্পেশাল প্রটোকল ব্যবস্থা চালু হওয়ায় বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে মেলামেশার যে সুযোগ পেতেন রাষ্ট্রপতির স্পেশাল প্রটোকল ব্যবস্থা চালু হওয়ায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনগণ ও জনপ্রতিনিধিগণ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এর ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একদল উচ্চাভিলাষী ও বিপথগামী অফিসার তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবার-পরিজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) এবং বাঙালি জাতি তাদের নেতাকে হারায়। তখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তার স্বামীসহ জার্মানীতে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান এবং আল্লাহর রহমতে সেই শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন (সরকার অনুমোদিত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন