বল কোর্টের বাইরে পড়া দেখেই র্যাকেট ছেড়ে শুয়ে পড়লেন কারবার। কিছুক্ষণ থাকার পর উঠে দাঁড়ালেন। চোখ ভেজা। অশ্রুসজল চোখেই হাসছেন। এ যে আনন্দাশ্রু। কাঁদতে কাঁদতেই জড়িয়ে ধরলে সেরেনা উইলিয়ামসকে। কারবারকে অভিনন্দন জানালেন মার্কিন কৃষ্ণকলি। ততক্ষণে যে ইতিহাস হয়ে গেছে। প্রথমবারের মতো টেনিসের কোন গ্র্যান্ড সø্যামের ফাইনালে উঠেই শিরোপা জিতলেন জার্মানির অ্যাঞ্জেলিক কারবার। তাও আবার পাওয়ার টেনিসের অন্যতম প্রবক্তা সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে। আর খুব কাছে গিয়েও ইতিহাস থেকে দূরে সরে গেলেন সেরেনা। টেনিসের ওপেন যুগে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড সø্যাম জয়ের সংখ্যায় স্টেফি গ্রাফকে ছোঁয়ার সুযোগটা আরও একবার হাতছাড়া করলেন মার্কিন টেনিস তারকা। এবারের অস্ট্রেলিয়ান ফাইনালে জার্মানির অ্যাঞ্জেলিক কারবারের কাছে ৪-৬, ৬-৩, ৪-৬ গেমে হেরে শিরোপা খুইয়েছেন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা সেরেনা। গত বছরের ইউএস ওপেনের পর এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, টানা দুবার গ্র্যান্ড সø্যামের ফাইনালে উঠে হেরে গেলেন ২১টি গ্র্যান্ড সø্যাম বিজয়ী। আর মেলবোর্ন পার্কের জ্বলে উঠে ক্যারিয়ারে প্রথম গ্র্যান্ড সø্যাম জিতলেন কারবার। টেনিসের উন্মুক্ত যুগে মেয়েদের এককে সর্বোচ্চ ২২টি গ্র্যান্ড সø্যাম জেতা স্টেফি গ্রাফ তার শেষ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন শিরোপাটি জিতেছিলেন ১৯৯৪ সালে। এরপর প্রথম মহিলা খেলোয়াড় হিসেবে বছরের প্রথম এই গ্র্যান্ড সø্যামে চ্যাম্পিয়ন হলেন কোনো জার্মান। শুধু তাই নয়, এবারই প্রথমবারের মতো কোনো গ্র্যান্ড সø্যামের ফাইনালে উঠেছিলেন কারবার!
শুরু থেকেই নিজের উদ্যম ধরে রেখে খেলছিলেন এই জার্মান। প্রথম সেটটা জিতে নিলেন ৬-৪ এ। অনেক দিন পর একটু ভিন্ন স্বাদ পেলেন সেরেনা। ২০১১ ইউএস ওপেনের পর এই প্রথম কোনো গ্র্যান্ড সø্যাম ফাইনালের প্রথম সেটে হারলেন। একটু কী অহমে আঘাত লাগল সেরেনার? দ্বিতীয় সেটে যে আবারও তিনি টেনিসের অগ্নিকন্যা। পাওয়ার টেনিসের প্রদর্শনীতে বশে নিয়ে এলেন র্যাঙ্কিংয়ের ছয়ে থাকা কারবারকে। ৬-৩ এ জিতে নিলেন সেট। দুই সেটে দুই ভিন্ন সেরেনার মধ্যে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ‘আনফোর্সড এরর’। প্রথম সেটে যেখানে ২৩টি অযাচিত ভুল করেছিলেন, দ্বিতীয় সেটে সেটি কমে এল ৫-এ! সঙ্গে এই সেটে ১৬টি উইনার তো আছেই। টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচে এসে আরেকটা ‘প্রথমে’র দেখা পেলেন সেরেনা। এর আগে টুর্নামেন্টে কোনো ম্যাচেই তিন সেটে যেতে হয়নি শারাপোভা, রাদভান্সকাকে হারানো মার্কিন কৃষ্ণকলির। সবগুলো ম্যাচই জিতেছিলেন সরাসরি সেটে। অবশ্য তৃতীয় সেটের রেকর্ড তাঁর পক্ষে ছিল। তিন সেটে গড়িয়েছে, এর আগে এমন ৮টি টুর্নামেন্টের ফাইনালে হারেননি সেরেনা।
তৃতীয় সেটে এসেই চিত্রনাট্য উলটে গেল। তবে এই সেটেও দুজন মিলে দেখিয়েছেন টেনিসের দুর্দান্ত প্রদর্শনী। সেরেনার সামনে সুযোগ ওপেন যুগে মেয়েদের টেনিসে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার সুযোগ (স্টেফি গ্রাফের সমান ২২টি), আর কারবারের প্রথম। জয়ের তাড়না কারোরই কম নয়। সেটটা দুললও পেন্ডুলামের মতো। তবে প্রবাদের এই কল্পিত কাঁটা দুই ঘর করে এগোচ্ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলোনা সেরেনার ৪-৬ সেটে জিতে নতুন একজন রানী পেলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন।
ম্যাচে এত এত ব্রেক হয়েছে, এমন ম্যাচের শেষটাও ব্রেক দিয়েই হবে - সেটি হয়তো নিয়তিই ছিল। সেরেনার সার্ভিসটা ব্রেক হতেই মাটিতে শুয়ে পড়লেন কারবার। মুখে হাত, হাসি-কান্নার মিশ্র অনুভূতি। হয়তো নিজেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের অনুভূতি ঠিক কেমন! ম্যাচের পুরস্কারের মঞ্চেই জানা গেল তার উত্তর। প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি সেরেনাকে তার অনুপ্রেরণা বলে জানান। আর এই শিরোপা জয়ে তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলেও জানান, ‘এর জন্য আমি সারাটা জীবন পরিশ্রম করেছি। এখন আমি বলতে পারি, আমি একজন গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন।’ দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা ফাইনালে হারের পর প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানাতে সেরেনা বলেন, ‘অভিনন্দন। তুমিই এর যোগ্য, আমি তোমার জন্য খুব খুশি। আমি সত্যিই আশা করি, তুমি মূহূর্তটা উপভোগ করেছ।’
কি তখনও শেষ হয়েছে? অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা জয়ের পরদিন সাংবাদিকদের হাত থেকে ফুরসত পান না তারকারা। আর কারবার কিনা তাদের বদলে সময় দিলেন ইয়ারার পানিকে। তবে এমন ঘটনা যে কারবারই প্রথম করেছেন তা বলা যাবে না। এর আগেও ১৯৯১ সালে বরিস বেকারও ইয়ারার পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরতো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয় করার পর জিম কুরিয়ার তার কোচকেও রেহাই দেননি। কোচ ব্র্যাড স্টিনকে নিয়েই পানিতে নেমেছিলেন। ১৯৯৩ সালেও একই কাজের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন কুরিয়ার।
পুরোনো রাজা
ম্যাচ শেষ। চ্যাম্পিয়নও পেয়ে গেছে মেলবোর্নের কোর্ট। তবুও নেই প্রবল উত্তেজনার বাড়াবাড়ি। স্বাভাবিকভাবেই বুক মেলালেন হেরে যাওয়া প্রতিযোগীর সঙ্গে। এরপর অতি পরিচিত মেলবোর্নের কোর্টে চুমু আঁকলেন সযতেœ। ঠোঁটে আলতো হাসি। একটু সামনে গিয়ে পিচে চুমু খেলেন। কী শান্ত, কী সুস্থির! দেখে কে বলবে, এই মাত্র অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের রেকর্ড সংখ্যক ৬টি শিরোপা জিতে রয় এমারসনের পাশে বসলেন! নাকি অভ্যাসের কারণেই এমন নির্লিপ্ত! এর আগে তিনবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে মারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তিনবারই জিতেছিলেন। চতুর্থবারে এসেও ফলটা বদলাল না। র্যাঙ্কিংয়ের দুইয়ে থাকা মারেকে ৬-১, ৭-৫, ৭-৬ (৭-৩) গেমে হারিয়ে ক্যারিয়ারের ১১তম গ্র্যান্ড সø্যামটি জিতলেন জোকোভিচ, ছুঁয়ে ফেললেন বিয়ন বোর্গ, রড লেভারকে। তবে উন্মুক্ত যুগে সবচেয়ে বেশিবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা জেতার রেকর্ডতো গড়লেন তিনিই। ২০০৮ থেকে ২০১৬, এর মধ্যে ছয়টি শিরোপা জিতলেন সার্বিয়ান টেনিস তারকা।
শুরুটা ঝড়ের বেগেই করেন জকোভিচ। যেখানে মারে ছিলেন অসহায়। প্রথম সেটটা জকোভিচ জেতেন ৬-১ ব্যবধানে। যেখান একটি মাত্র গেমই জিতেছেন মারে। তবে প্রত্যয়ী মারে ফেরার চেষ্টা করেছেন পরের সেটেই। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে সেটটাকে নিয়ে যান টাইব্রেকারে। কিন্তু হায়, জয় পান জকোভিচই। তৃতীয় সেটের চিত্রও তাই। কঠিন লড়াই করলেন মারে। কিন্তু অদম্য জকোভিচ ছিলেন আরও ভয়ংকর। শেষ হাসি তার মুখেই।
মারের সঙ্গে ৩১ বারের মুখোমুখি লড়াইয়ে জোকোভিচের এটা ২২তম জয়। তার মধ্যে শেষ ১২ ম্যাচে ১১টিতেই জিতেছেন ২৮ বছর বয়সী এই তারকা। ম্যাচ শেষে চ্যাম্পিয়ন প্রতিপক্ষকে শুভেচ্ছা জানাতে মারে বলেন, ‘ছয় বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতা অবিশ্বাস্য এক অর্জন। গত বছরটা ছিল অবিশ্বাস্য। দারুণ করেছ।’ আবারও এখানে ফাইনালে উঠে শিরোপার স্বাদ না পাওয়া মারের উদ্দেশ্যে জোকোভিচ বলেন, ‘সে অসাধারণ এক চ্যাম্পিয়ন, দারুণ বন্ধু। আমি নিশ্চিত, এই ট্রফি জেতার সুযোগ সে আরও অনেকবার পাবে।’ নিজের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার টিমম্যাটদের। যাদের কারণে এই পজিশনে আমি। তবে দুঃখিত, আমি পারিনি।’ বাবা হতে যাওয়া মারেকে আগাম অভিনন্দন জানাতেও ভোলেননি জোকার, ‘তাকে সম্মানই জানাচ্ছি, দারুণ একটা টুর্নামেন্টের জন্য। আজকের রাতটি ছিল কঠিন ভাগ্যেরেই। সে (মারে) গ্রেট চ্যাম্পিয়ন, মহৎ বন্ধু ও একজন পেশাদার খেলোয়াড়। আশা করি এই ট্রফি জেতার সুযোগ সে অনেক পাবে। আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি কিমকে (মারের স্ত্রী)। শুভ কামনা অনাগত সন্তানের জন্য। আশা করি মারে উপভোগ করবে নতুন অভিজ্ঞতা। যা আমি ও আমার স্ত্রী পেয়েছি’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন