পুরান ঢাকার বাবুবাজার থেকে কেরানীগঞ্জ, নয়াবাবাজর থেকে গুলিস্তান রুটে অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এর মধ্যে রয়েছে বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার, টেম্পু ও অটোরিকশা। যাত্রীবাহী এসব যানের বাহ্যিক অবয়ব দেখলেই বোঝা যায়, এগুলো ফিটনেসের যোগ্য নয়। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে কাঁচপুর সেতুৃর ওপাড় পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বাস চলাচল করে যেগুলোর কোনো ফিটনেস সনদ নেই। মতিঝিল থেকেও বিকালের পর হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে সানারপাড় পর্যন্ত চলে বেশ কয়েকটি ফিটনেসবিহীন বাস। পরিবহন শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিআরটিএ এবং পুলিশকে ম্যানেজ করেই ঘুৃরছে নিষিদ্ধ এসব যানের চাকা। পুরো প্রক্রিয়ার নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক লেনদেন। আবার ফিটনেসের যোগ্য না হয়েও লক্করঝক্করমার্কা গাড়িকে ফিটনেস দেয়া হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। যার নেপথ্যে বিআরটিএ-এর দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা।
সারা দেশের সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এসব যানবাহনের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের তালিকা। ফিটনেসবিহীনের সঙ্গে অবাধে চলাচল করছে অবৈধ যানবাহনও। করোনাকালেও কমেনি তাদের দাপট। এমনকি পুলিশের পরিবহন পুলেও রয়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। নিয়মিত অভিযান নেই। পুলিশ মাঝেমধ্যে এসব যানবাহন জব্দ করে আবার ছেড়ে দেয়। এদিকে, রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি চালালেই তা ডাম্পিং করার নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার ডিএমপি’র সদর দফতরে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সংশ্লিষ্ট উপ-পুলিশ কমিশনারদের তিনি এ নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন র্কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, সারা দেশে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে। যদিও পুলিশের হিসাবে, এ সংখ্যা আরও বেশি। যানবাহনের সংখ্যা অনুযায়ী বিআরটিএতে ফিটনেস দেখভালে পাঁচ শতাধিক মোটরযান পরিদর্শক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ১০৩ জন। এতে লোকবলের অভাবে সঠিকভাবে ফিটনেস পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। পরিবহন মালিক ও চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিআরটিএ অফিসে গিয়ে লাইনে গাড়ি দাঁড় করালে এক দিনেই ফিটনেস সনদ পাওয়া যায়। এজন্য গাড়িপ্রতি ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে ভোগান্তির শেষ নেই। এজন্য সনদ নেওয়ার পরিবর্তে মালিক ও চালকরা পুলিশ এবং বিআরটিএ- কে ম্যানেজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।
জানা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদের অর্ধশত বৈঠকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত ও পুরনো গাড়ি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ১০ বছর দফায় দফায় ঢাকা মহানগরীর ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালে গণপরিবহনে সুষ্ঠু যাত্রীসেবা নিশ্চিতে যে ২৬ দফা সুপারিশ তৈরি করা হয়, তার অন্যতম ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সড়কে চলাচলকারী পুলিশের অনেক যানবাহনের ফিটনেস নেই। জেনেও এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান জোরদার করে পুলিশ ও বিএরটিএ। তখন অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সড়কে ফেরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সড়কে চলাচলকারী বেশিরভাগ যানবাহনের মালিক প্রভাবশালী। এদের অনেকে রাজনীতি করেন। এসব প্রভাবশালী ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হলেও নবায়ন করেন না। অভিযান চালালে ধর্মঘটের হুমকি দেন। ফলে ঠিকমতো অভিযানও হয় না। দফায় দফায় মালিকপক্ষের সঙ্গে পুলিশ ও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চালানোর আশ্বাস দেওয়া হলেও পরে মানেন না মালিক-চালকরা। উল্টো অভিযান চালালে প্রভাবশালীরা তদবির করে গাড়ি ছাড়িয়ে নেন।
ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বিআরটিএতে নিবন্ধিত ২০ ধরনের গাড়ির মধ্যে রাজধানীতে চলাচল করছে ৫ হাজার বাস-মিনিবাস। এসব যানবাহনের ৮৮ শতাংশের ফিটনেস নেই। ২০০২ সালেই এসব গাড়ির আয়ুষ্কাল ২০ বছর অতিক্রম করেছে। মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৪ অনুসারে, মোটরসাইকেল ছাড়া বাস-মিনিবাস বা প্রাইভেটকারের মতো গাড়ির বছরে একবার ফিটনেস পরীক্ষা করাতে হয় বিআরটিএ কার্যালয়ে। গাড়ির নির্মাণকালীন নকশা অক্ষত থাকা, ব্রেক-গিয়ার ঠিক থাকা, দরকারি বাতি থাকা, কালো ধোঁয়া বের না হওয়া, রং ঠিক থাকা গাড়িকে চলাচলের উপযোগী বলা হয়। ফিটনেস পেতে অন্তত ৩৬ ধরনের কারিগরি ও বাহ্যিক বিষয় পরীক্ষা করতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এই ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা খালি চোখেই এসব পরীক্ষা করছেন। আবার মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় মোটরযান পরিদর্শকের অনুপস্থিতিতেই গাড়ি দেখে ফিটনেস যাচাই করা হয়।
গত কয়েক দিন সরেজমিনে দেখা যায়, পুরান ঢাকার বাবুবাজার, নয়াবাজার, তাঁতীবাজার, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, রামপুরা, মিরপুর, গাবতলী, প্রগতি সরণি, উত্তরা, পল্টনসহ বিভিন্ন স্থানে শিকড়, ইটিসি, কনক, তুরাগ, স্বকল্পসহ বিভিন্ন পরিবহনের গাড়ির বেশিরভাগের দরজা-জানালা ভাঙা। কোনো কোনোটিতে বসার আসন নেই। লুকিং গøাসও নেই। পুলিশের চোখের সামনেই এসব চলাচল করছে।
গত বছর সরকার নতুন করে সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি ও জরিমানা বাড়ায়। আইনে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালালে ৬ মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা বা উভয় দÐের বিধান রাখা হয়। এর বাইরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধসহ নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার জন্য গত আট বছরে ২৪০টি সুপারিশ করেছে বিভিন্ন কমিটি। দুদকও ২১টি সুপারিশ দিয়েছে। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি ও জরিমানা বাড়ানো এবং পরে আইনের বিধিমালা করা হলেও মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের অভাবে থামানো যাচ্ছে না ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিকের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) আবদুর রাজ্জাক বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরপরও সড়কে অনেক ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করছে। এগুলোকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন