বলা হয়ে থাকে যে, ‘দুর্নীতিতে দেশ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে।’ কথাটার সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। এই রোগাগ্রস্ত হওয়ার মূল কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, আমরা ইসলামের আদর্শ অনুসরণের কথা মুখে উচ্চারণ করলেও কার্যত বিপরীত কাজই করে থাকি এবং সর্বত্রই আমরা দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকি। বলা বাহুল্য, দুর্নীতি বহুমুখী অপরাধের উৎস-মূলরূপে সমাজে বিরাজ করছে। আরবিতে ‘খেয়ানত’ শব্দ দ্বারা দুর্নীতিকে বুঝানো হয়ে থাকে। আর এ ‘খেয়ানত’ সমাজে কীভাবে প্রচলিত, তা ব্যাখ্যা করলে এর শত শত প্রকার বের হয়ে আসবে, যেগুলোর প্রত্যেকটিকে মারাত্মক অপরাধরূপে গণ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ঘুষের বিনিময়ে কারো কোনো কাজ করে দেয়া অথবা কোনো কাজ করার নামে ঘুষ গ্রহণ করাকে সাধারণত দুর্নীতি বলা হলেও এর শাখা প্রশাখাগুলো অসংখ্য-অগণিত। কাজেই দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা ব্যতীত সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
সত্যিকারভাবে, একমাত্র ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণের মাধ্যমেই দুর্নীতির উচ্ছেদ করা সম্ভব। এ জন্য ইসলামে ‘খেয়ানত’ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অধিক জোর দেয়া হয়েছে। আল্লাহর অধিকারসমূহে যেমন খেয়ানত করার কোনো অবকাশ রাখা হয়নি, তেমনি মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব পালনেও খেয়ানত করার অনুমতি দেয়া হয়নি। সুতরাং, দুর্নীতির উৎসগুলো নির্ণয় করে সেগুলো দমন করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর ইসলামে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা কী, তা ভেবে দেখার বিষয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এই জগতের কোনো এলাকায় যখন নীতিহীনতা, বর্বরতা, উলঙ্গপনা প্রভৃতি নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতনের প্রাদুর্ভাব হয়, তখন অর্থলোভ মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং সংক্রামক ব্যধির ন্যায় এটা সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। ধর্মের প্রতি অনুরাগ, হালাল-হারামের পার্থক্য এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ঘুষ, চোরাকারবারি, স্বজনপ্রীতি, পাচার, হত্যা, লুটরাজ, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি সব অবৈধ ঘৃণিত ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সমাজজীবন হতে সত্য-ন্যায়, সুবিচার চিরতরে লোপ পেয়ে যায়।
যেমন, ঘুষের কথাই ধরা যাক। বুদ্ধিসম্পন্ন এমন কোনো লোক নেই যে, একে খারাপ মনে করে না এবং প্রত্যেকে স্বীকার করে যে, এটা ঈমান-আখলাকের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ঘুষ যারা গ্রহণ করে আর যারা প্রদান করে উভয়ই একে ঘৃণা করে। প্রত্যেক বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি অবগত আছে যে, চুরি, আত্মসাৎ, ধোঁকাবাজি এবং ঘুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু তা সত্তে¡ও ঘুষ আমাদের সমাজের বন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। অথচ ঘুষের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পত্তির কোনো মর্যাদা নেই। কোনো মুসলমান এটা ভুলতে পারবে না যে, পরহেজগারী বা শুদ্ধচরিত্রতা অর্জনের জন্য প্রথম শর্ত হলো, হালাল রুজি বা বৈধ উপার্জন। কোনো মুসলমান জেনে-শুনে হারাম উপার্জন ভোগ করলে তা হবে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী অত্যন্ত ঘৃণিত ও নিন্দনীয়।
কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কিছু দিয়ে নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা এবং অন্যায় দাবি পূরণ করার নাম ‘রিশওয়াত’ বা উৎকোচ। আমাদের সমাজে ঘুষ হিসাবে পরিচিত এ সমাজবিরোধী কারবার অতীতেও প্রচলিত ছিল। হজরত নবী কারীম (সা.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবের গণক প্রভৃতি শ্রেণীর লোকেরা কোনো লোকের মামলা মোকদ্দমার বিচার করত। স্বার্থপর লোকেরা নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির নিমিত্তে তাদেরকে ঘুষ হিসাবে কিছু নজরানা দিত এবং একে তারা ‘হালুয়া’ বলত এবং তথাকথিত বিচারক ন্যায় ও সত্যের বিরুদ্ধে ‘হালুয়া’ দানকারীদের সপক্ষে রায় দান করত। এভাবে আহলে কেতাবের (গ্রন্থধারী) মামলা যখন এ সকল ধর্মীয় নেতার সামনে পেশ করা হত, তাদেরকে প্রকাশ্যে ঘুষ দান করত এবং তারা ঘুষ গ্রহণ করে তাওরাত ও বাইবেলের নির্দেশাবলির ইচ্ছাকৃতভাবে বিরুদ্ধাচারণ করে সেগুলোতে অন্তরায় সৃষ্টি করত।
আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিশ্চয় যেসব লোক এ সমস্ত আয়াত আহকামকে গোপন করে, যা আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করেছেন এবং যেগুলোর বিনিময়ে যৎ সামান্য মূল্য গ্রহণ করে, তারা নিজেদের পেটে আগুন ভর্তি করছে। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে কোনো কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন