একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই মুসলমানদের দুর্দিন অতিবাহিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় জীবন হতে শুরু করে ব্যক্তি জীবন পর্যন্ত এমন কোনো অঙ্গন নেই, যেখানে মুসলমানের স্বকীয়তা, ইজ্জত-হুরমত যথাযথভাবে অপরিবর্তিত আছে।
দুনিয়াজোড়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ষোলআনাই পরনির্ভরশীল ও পরের হাতের খেলার গুটি। ‘যেমনি নাচাও, তেমনি নাচি’ এর উজ্জ্বর দৃষ্টান্ত। কেউ যদি তালাশ করতে চায়, তাহলে তাকে বেশি দূরে যেতে হবে না। বরং গোটা বিশ্বের কোনো একটা মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি তাকালেই যে দেখতে পাবে যে, রাষ্ট্রের প্রতি তাকালেই সে দেখতে পাবে যে, মুসলমানরা পরের কথায় নাচতে কত পটু। তাদের রাজনৈতিক জীবনের অভিনয় দুনিয়ার নাম করা অভিনেতা ও অভিনেত্রীকেও হার মানায়, তা হলফ করে বলা যায়। কেন যায় কি জন্য যায়, এর তপ্ত তালাশকে সুদূর বিস্তৃত জলধার তরঙ্গ শঙ্কুল অবস্থার সাথে তুলনা করা মোটেই অবান্তর নয়।
পৃথিবীব্যাপী সাতটি মহা সমুদ্রের বুকে কত যে ঢেউ, কত যে তরঙ্গ খেলে বেড়ায়, তার হিসাব যেমন কেউ রাখে না, তেমনি মুসলমান নামধারী রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নর্তন-কুর্দনের এবং মিথ্যাচারিতার হাদিসের প্রতিও কেউ নজর দেয় না। কারণ, তারা মূলতঃ ‘দিন যায়, কথা থাকে’র ঝরা পাতা বৈ কিছুই নয়। তাদের অবস্থা আঁচ করেই হয়তো বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত ব্যথিতচিত্তে বলেছিলেন, ‘অতিসত্বর মানুষের মধ্যে এমন একটি সময় চাঙা হয়ে উঠবে, যখন ইসলামী জীবন বিধান অবশিষ্ট থাকবে না, শুধুমাত্র এর নামটি বাকি থাকবে।’ তাইতো মুসলমান নামের তকমা আঁটা মানুষগুলোর ওপর অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোর আক্রমণাত্মক কার্যক্রম জোরেশোরে চলছে। এ চলার শেষ কোথায়, তা বলার মতো কেউ আছে বলে মনে হয় না।
সে যাই হোক, দুর্যোগপূর্ণ এ পৃথিবীতে মুসলমানদের টিকে থাকার একটি পথই খোলা আছে। সেটি হলো, ‘একান্তভাবে আল্লাহকে রব ও প্রতিপালক হিসেবে স্বীকার করে নেয়া এবং আল্লাহর নিকট নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা।’ এ শ্রেণির আত্মসমর্পণকারীদের জন্য আল্লাহপাকের দেয়া সুসংবাদ রয়েছে। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘নিশ্চয়ই যারা বলে, আল্লাহই আমাদের একমাত্র বর, তারপর এ বিশ্বাসের ওপর সুদৃঢ় ও অবিচালিত থাকে। (তথা) তাদের প্রতি ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয়। (আর বলতে থাকে) তোমরা ভয় করো না এবং চিন্তান্বিতও হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি প্রতিশ্রæত জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর।’ (সূরা হা মীম সাজদাহ : ৩০)।
এ আয়াতে কারিমায় যে শুভ সংবাদ প্রদান করা হয়েছে, তাকে ৫টি শ্রেণিতে বিন্যাস করে ইমাম ফকিহ আবুল লাইছ সমরকন্দি (রহ.) এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন: এক. এ শুভ সংবাদ সাধারণ মোমিনের জন্য। অর্থাৎ তোমরা সর্বদা আযাবে পড়ে থাকার ভয় করো না। কেননা, অবশ্যই তোমাদের একদিন আযাব থেকে মুক্তি দেয়া হবে। নবীগণ ও সালেহগণ তোমাদের জন্য সুপারিশ করবেন।
দুই. এ শুভ সংবাদ মুখলিসগণের জন্য। (মুখলিস সেই ব্যক্তি যে সর্বাত্মকভাবে আল্লাহ নির্ভরশীল ও স্বীয় সৎকর্মসমূহকে এমনভাবে গোপন রাখে, যেমন সে স্বীয় অসৎকর্মসমূহ গোপন রাখে)। অর্থাৎ তোমরা নিজেদের আমল কবুল না হওয়ার ভয় করো না। কেননা, তোমাদের আমলসমূহ মকবুর এবং গ্রহণযোগ্য। আর সওয়াব হতে বঞ্চিত হওয়ার চিন্তাও করোনা। কেননা, তোমাদের দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হবে।
তিন. এই শুভ সংবাদ তাওবাহকারীদের জন্য। অর্থাৎ তোমরা নিজেদের গোনাহ সম্পর্কে ভয় করোনা। তোমাদের গোনাহ তো ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এবং খালেস তাওবাহ করার পর সওয়াব থেকে বঞ্চিত হওয়ারও ভয় করো না।
চার. এই শুভ সংবাদ যাহেদ বা কৃচ্ছতা অবলম্বনকারীদেন জন্য। অর্থাৎ তোমরা হাশর এবং হিসাব নিকাশ সম্পর্কে ভয় করো না। বরং হিসাব নিকাশ ছাড়াই তোমরা জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ গ্রহণ করো।
পাঁচ. এই শুভ সংবাদ ওলাাময়ে কেরামের জন্য। অর্থাৎ ওই সকল ওলামায়ে কেরাম যারা মানুষকে কল্যাণ ও সৎকর্ম শিক্ষা দেন এবং নিজের এলেম অনুযায়ী আমল করেন। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা কেয়ামতের বা দুর্যোগপূর্ণ ভয়াবহ দৃশ্যকে ভয় করো না এবং বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তাও করো না। অবশ্যই আল্লাহপাক তোমাদের হেফাজত করবেন এবং তোমাদের কর্মের প্রতিদান প্রদান করবেন। সুতরাং তোমরা এবং তোমাদের অনুসারীগণ জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো। (রওজাতুস সালেহিন : ১ম খন্ড, পৃ. ৪১)।
মোট কথা, সাধারণ মুমিনগণ, মুখলিসগণ, তাওবাহকারীগণ, যাহেদ ও কৃচ্ছতা অবলম্বনকারীগণ ও ওলামায়ে কেরাম পৃথিবীতে লবণের ন্যায় উপকারী। কেননা, সকল নষ্ট বস্তু লবণ দ্বারা সংশোধন করা হয়। এজন্যই তো সাতটি মহা সমুদ্রের পানি লবণাক্ততায় ভরপুর। কিন্তু লবণই যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের সংশোধন কী করে সম্ভব হবে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন