বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

‘সংসারই চলে না আর শীতের কাপড়’

শীতে কাঁপছে ছিন্নমূল মানুষ

সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

সকাল-সন্ধ্যায় হালকা কুয়াশা, দুপুরে কড়া রোদ। বেলা গড়ালেই বাড়ছে কুয়াশা। সকাল পর্যন্ত থাকছে সেই দাপট। শীতল হাওয়ায় দুপুরেও তেজহীন সূর্য। বিত্তবানদের কাছে এটি হয়ে উঠছে উপভোগ্য। তবে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে তা দুর্বিষহ।
সারাদিন নানা কাজ শেষে সিরাজগঞ্জ শহরের রেলওয়ে বাজার স্টেশন, খোলা মাঠ, বাসা-বাড়ি ও অফিস-আদালতের বারান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া ছিন্নমূল মানুষেরা শীতবস্ত্রের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বাজার স্টেশন প্লাটফর্মে থাকা ভিক্ষুক ফুল ভানু (৯৫) বলেন, প্রায় ৪৫ বছর আগে স্বামী মারা গেছে। যমুনা নদীতে বাড়ি ঘর-বিলীন হয়ে যাওয়ার পর একটি মেয়েকে নিয়ে শহরে আসি। আত্মীয়-স্বজন নেই। রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে জায়গা নিই। প্রায় ২০ বছর ধরে এখানেই আছি। গরমের সময় এখানে থাকতে তেমন অসুবিধা হয় না। শীতকালে পড়ি চরম বিপাকে। ঠান্ডা বাতাসে শরীর জমে যায়। ঠান্ডার কারণে এই বয়সেই মাঝরাতে বসেই রাত পার করতে হয়। মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছি। তাদের সংসারই ঠিকমতো চলে না। তাই ভিক্ষা করে কোনোমতে বেঁচে আছি।

শুধু ফুল ভানুই নয়, তার মতো এমন অনেক ছিন্নমূল মানুষ সিরাজগঞ্জের রেলস্টেশনসহ ফুটপাত ও অলিগলিতে শীতের প্রকোপে কাবু হয়ে মানবেতর রাত কাটাচ্ছেন। শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, শীত থেকে রেহাই পেতে অনেকেই পলিথিন টানিয়ে রাস্তার পাশে শুয়ে-বসে আছেন। কেউ বা আগুন জ্বেলে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।

সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের পুরাতন জেলখানা ঘাট এলাকার নুরজাহান বেগম (৪০) ও স্বামী ঝন্টু শেখ (৪৮) বলেন, প্রায় ১৬ বছর আগে আমরা দুজন পত্রিকা বিক্রি করে সংসার চালাতাম। দুজনের রোজগারে সংসার ভালোই চলছিলো। কিন্তু সেটা বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি।
হঠাৎ করে সিরাজগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়কের কড্ডার মোড় এলাকায় বাসের নিচে পড়ে স্ত্রী নুর জাহান। একটি পা কেটে যায় তার। টাকা পয়সা তেমন না থাকায় স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে চলতে হতো। স্ত্রী ও মেয়ে শিল্পী খাতুনকে (১৪) নিয়ে এখন রেলওয়ে স্টেশনে রাত যাপন করেন তারা। শীতের এই রাতে পঙ্গু স্ত্রী ও কন্যা সন্তান নিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয় তাদের।

ঝন্টু শেখ বলেন, শীতের কোনো কাপড় নেই। কম্বলও পাচ্ছি না। একটা পাতলা কাঁথা আর চাদর গায়ে দিয়ে অনেক কষ্টে রাত কাটাচ্ছি। ঘড়ির কাটায় রাত ঠিক সাড়ে ১২টা। বাজার স্টেশন টিকিট কাউন্টারের সামনে শীতের রাতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ফুটপাতের রাস্তায় দেখা যায় দুটি বস্তা পড়ে আছে। দূর থেকে মনে হবে পরিত্যাক্ত কিছু পড়ে আছে। ধীরে ধীরে কাছে দিয়ে দেখা গেলো বস্তার ভিতরে ঢুকে মুড়িয়ে দুজন ছিন্নমূল মানুষ শুয়ে আছেন। শীতের হিমেল হাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই প্রচেষ্টা তাদের। তবুও ঘুম আসছে না। শীতের হিমেল বাতাস ঘুমাতে দিচ্ছে না তাদের।

শীতে কাঁপতে কাঁপতে ছিন্নমূল আনিছুর রহমান (৫৫) বলেন, সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত শীত বেশি থাকে। কোন ধরনের কাপড়-চোপড়ও নেই। শীত নিবারণের একমাত্র উপায় একটা সোয়েটার। সারারাত বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই কাটিয়ে দিই।’

পরিবেশবাদী সংগঠন দি বার্ড সেফটি হাউজের সভাপতি মামুন বিশ্বাস জানান, জেলার ছিন্নমূল মানুষের সঠিক সংখ্যা আলাদা করা নেই। যারা দীর্ঘদিন ফুটপাতে বসবাস করছে তাদের তালিকা তৈরি করে এলাকাভিত্তিক ভাগ করে দিলে ফুটপাতে থাকা মানুষগুলো খাবারের অভাবে না খেয়ে থাকবে না। শীত শুরু হয়েছে। সবার সহযোগিতায় প্রথম দিকে ছিন্নমূল অসহায় শীতার্ত মানুষদের জন্য তিন হাজার পিস কম্বল বিতরণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। পর্যায়ক্রমে আরও বৃদ্ধি করব।

পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহরিয়ার শিপু জানান, সমাজে ছিন্নমূল মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেবা প্রদানে সব সময় কাজ করে যাচ্ছি। আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সমাজের বিভিন্ন বিত্তবান লোকজনও এই ছিন্নমূল মানুষদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন এতে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি। আগামীতে এভাবে কাজ করে যাব।
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল্লাহ শেখ জানান, সমাজের অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি তবে ছিন্নমূল শীতার্ত মানুষদের জন্য এখন পর্যন্ত শীতবস্ত্র আসেনি। আসলে ওই সকল অসহায় মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে শীতার্তদের সর্বাত্মক সহযোগীতা করার চেষ্টা চলছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন