বিগত দুই দশকে বাংলাদেশ ৬ শতাংশ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বিশ্বে দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির তালিকায় স্থান করে নেয়। সম্প্রতিক ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউট-লুকের (ডব্লিউইও) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ জিডিপি অর্থাৎ ১ হাজার ৮৮৮ মার্কিন ডলার অর্জন করবে। অথচ, এ সময় ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৮৭৭ মার্কিন ডলার হবে। ২০১৯ সালে ভারতে মাথাপিছু জিডিপি ছিল ২ হাজার একশত ডলার। কোভিট ১৯ মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারির মাঝেও অতিদ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবে। এ পূর্বাভাস বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিকে আরও গতিশীল করবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মোতাবেক, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশে উপনীত হয়েছিল এবং চলমান করোনা মহামারির মাঝেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রাক্কলন ঘোষিত হওয়ায় ২০২০ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের মাথাপিছু জি.এন.আই প্রাক্কলিত হয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। তাছাড়া দেশ মানব উন্নয়নের নানা সূচকে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। এসব উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের গতিশীলতার পরিচায়ক যদিও এ উচ্চ প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। তাছাড়া কোভিট-১৯ মহামারির ফলে বেকারত্ব অর্থনীতির জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে মোট জনসংখ্যার বিরাট অংশ হলো যুব সম্প্রদায়। বিবিএস-এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি প্রতিবেদন (২০১৬-২০১৭) অনুযায়ী যুব বেকারত্বের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। এটা বেকারত্বের পরিবেশকে আরো গুরুতর করে তুলেছে। কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা পূরণে অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। যেসব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা ব্যবসায়ে পুনরায় বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছে না। কোভিড-১৯ বেসরকারি বিনিয়োগ আরো স্থবির করে দিয়েছে। সরকারের মেগা প্রকল্পসমূহ বিশেষ করে মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজে স্লতগতি দেখা দেয়।
প্রকল্প ছোট হোক বা বড় হোক একটি প্রকল্পকে ঘিরে বহুমুখী অন্তর্জাল তৈরি হয়। প্রকল্প এলাকার পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন ব্যবস্থাসহ অনেক বিষয় ও সেক্টর জড়িত থাকে। সড়ক কিংবা ভবন নির্মাণ প্রকল্প হলে সেখানে প্রচুর নির্মাণ শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়। সড়ক নির্মাণ করতে রড, সিমেন্ট, বালুসহ নানা ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হয়। এতে মানুষের কর্মসংস্থান হয়। টাকা হাত বদল হয়। দেশজ উৎপাদনে বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
পক্ষান্তরে প্রকল্প গ্রহণে যদি কোনো ত্রুটি হয় কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়নে যত দেরী হয়, তত তার ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। জনগণের অর্থের অপচয় হয়। যেকোনো প্রকল্প যদি যথাসময়ে সম্পন্ন না হয়, তাহলে প্রকল্পের সাথে জড়িত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপাদান, উপকরণ ও সংশ্লিষ্ট খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যেকোনো প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করা ও সেই লক্ষ্যে তদারকি জোরদার করা উচিত। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে, সেসব প্রকল্পের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে দ্রুত যোগাযোগের লক্ষ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয় প্রায় এক দশক আগে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে যে মেয়াদ ছিল তা বৃদ্ধি করে ২০২৩ সাল করা হয়। এরপরও সংশোধিত সময়ে পুরো প্রকল্প শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাছাড়া করোনার কারণ তো রয়েছেই।
পদ্মাসেতু: কনস্ট্রাকশন কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, প্রকল্প শেষ হওয়া সম্ভাব্য সময় ধরা হয় ২০২২। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৩০১.৯৩৩ বিলিয়ন টাকা। চার লাইন সমৃদ্ধ সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার ও স্প্যান সংখ্যা ৪১টি পত্রিকার খবর অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ৭৯৬ দশমিক ২৪ কোটি টাকা। দৈর্ঘে পদ্মাসেতু বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় ১.৩০ গুণ। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে সময় লেগেছে ৪ বছর ৪ মাস। পদ্মাসেতু ২০২২ সালে চালু হলেও সময় লাগবে ৭ বছর ৬ মাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাড়তি খরচ মিলিয়ে পদ্মাসেতুর নির্মাণ ব্যয় হবে বঙ্গবন্ধুর সেতুর প্রায় ৪ গুণ। তবে এ বৃহৎ সেতু নির্মাণে সময় যদি আরও বাড়ে তবে ব্যয়ও বাড়বে।
এছাড়া ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখানে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যা অনেক ব্যয় বহুল ও দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ। সরকার দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ অর্থনীতি অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৮০টি প্রকল্প রয়েছে, যার অর্জন নগন্য। এসব প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্তভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে অর্থনীতির উন্নয়ন ও শিল্পায়নের স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে। চলমান মেগা প্রকল্পগুলো কেবল উন্নয়ন প্রকল্প নয়, এসব প্রকল্পের সাথে দেশের কর্মসংস্থান, অবকাঠামোগত দিক, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক অর্থনীতিক উন্নয়নের বিষয়টিও জড়িত। দেশের উন্নয়নের জন্য বৃহৎ প্রকল্পের প্রয়োজন আছে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা সংস্থানও থাকা চাই। বারবার নকশা পরিবর্তন, বাস্তবায়নের ব্যয় ও সময়ক্ষেপণ হলে অর্থনীতির গতিপথে বাধা সৃষ্টি হয়। ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে অতিপ্রয়োজনীয় বড়, মাঝারী ও ছোট প্রকল্পে পর্যাপ্ত বরাদ্ধ দেওয়া সম্ভব হয় না।
করোনার এখন দ্বিতীয় ধাক্কা চলছে। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকে না। মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে নেমে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। আবার জীবনও রক্ষা করতে হবে। তাই সচেতনভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মজীবী মানুষকে চলা উচিত। করোনার কারণে প্রকল্পসমূহের কাজে গতিহীনতা দেখা দিয়েছে। বিদেশি শ্রমিকেরা এখনও কাজে ফিরছে না। এর মাঝেও ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশে যেসব প্রকল্প রয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। শুধু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষেত্রে নয়, ছোট বড় সকল প্রকল্প যথাসময়ে সম্পন্ন করার চেষ্টা করা উচিত। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে যত সময় নেয়া হবে তার ব্যয় তত বাড়বে। অর্থের অপচর হবে। ভোগান্তি প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণকেই ভোগ করতে হবে। সরকারের যথাযথ নির্দেশনা ও তত্ত¡াবধান না থাকলে পদ্মা সেতু বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পসমূহ যথা সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই মুহূর্তে জিডিপি নেতিবাচক প্রভাব প্রবৃদ্ধি দেখা দিচ্ছে। করোনা মহামারির মাঝে সেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সরকারি হিসাব মতে আমাদের জিডিপি ৫.২ শতাংশ। এটি আমাদের জন্য খুব খারাপ নয়। তবে করোনার মাত্রা বাড়বে বা হ্রাস পাবে তা বলা মুশকিল। অর্থনীতির গতিকে ধরে রাখতে হলে আমাদের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করার চেষ্টা করতে হবে। বেকার ও বেকারত্ব বৃদ্ধি নিরসনের উপায় বের করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়ে কার্যকর ও প্রাণশক্তি সঞ্চার করার জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ দ্রুত বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে পোশাক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এ দুটি খাতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। বর্তমান করোনা মহামারির সময় বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি শুভ না থাকলে আমাদের গার্মেন্ট ও রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। করোনা মহামারিকালেও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিবাচক ধারা রক্ষা করার একটি বড় উপাদান হলো বিনিয়োগ। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের উপর জোর দিতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ গত এক দশক ধরে প্রায় ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০২০ অর্থবছরে এর নিম্নমুখী হয়ে ১২.৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ যদি বৃদ্ধি করা না যায় তাহলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে। তাই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধান করা উচিত। বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়াতে হলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নীতি নির্ধারকদের আরও উদ্যোগী হতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে, কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং বিদেশে সম্পদ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন