বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মানবস্বাস্থ্যের ওপর বিভিন্ন দূষণের ভয়ঙ্কর প্রভাব

মাহমুদ কামাল এনামুল হক | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

পরিবেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মাটি, পানি ও বায়ু। বর্তমানে মানুষের কার্যকলাপের কারণে এই তিনটি উপাদান প্রতিনিয়তই দূষিত হচ্ছে। যে হারে দূষণের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে, তাতে দূষণ কবলিত পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে। দূষণের চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ দূষণজনিত কারণে আহত বা নিহত হচ্ছে। এই দূষণ জনজীবনকে ক্ষতিগস্ত করছে, প্রচুর জীবন ও জানমাল ধ্বংস করছে। দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিকদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, নদীদূষণ ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার প্রভাব মানুষের উপর সবচেয়ে বেশি।

পরিবেশ দূষণের সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনের ওপর। বিশ্বব্যাংকের জরিপ মতে, ২০১৫ সালে শুধু শহরাঞ্চলেই মারা গেছেন ৮০ হাজার ২৯৪ জন মানুষ। এর মধ্যে বায়ূ দূষণজনিত কারণে মারা যান প্রায় ৪৬ হাজার এবং পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য বিধিসংক্রান্ত কারণে মারা গেছেন প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ। পানি, স্যানিটেশন এবং অস্বাস্থ্যগত প্রত্যক্ষ প্রভাবে মারা গেছেন ৪ হাজার ৮০০ জন, পরোক্ষ প্রভাবে ৯৬৬ জন, পানিতে আর্সেনিকের কারণে প্রায় ১০ হাজার এবং পেশাগত পরিবেশ দূষণে মারা গেছেন প্রায় ১৯ হাজার মানুষ।

বায়ুদূষণ: বর্তমানে দূষণগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি-এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ৫৮% বায়ুদূষণের উৎস ঢাকার আশেপাশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইটের ভাটা। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে, শিল্পকারখানা, দহন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনঘন রাস্তা খনন, ড্রেনের ময়লা রাস্তায় পাশে উঠিয়ে রাখা, যানবাহনের অস¤পূর্ণ থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের প্যার্টিকুলেট ম্যাটার, অ্যাশ, ধূলিকণা, সীসা, কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়তই দূষিত করছে বায়ু। বায়ুদূষণের ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলোর মধ্যে নাক মুখ জ্বালাপোড়া করা, মাথা ঝিম ঝিম করা, মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি অন্যতম।

শব্দ দূষণ: যানবাহনের হাইড্রলিক হর্ন, সড়ক যানবাহন, রেল ও নৌযানের হর্ন, ভিআইপি/ইর্মাজেন্সি হর্ন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহবনের/মেশিনের যান্ত্রিক শব্দ, যত্রতত্র মাইকের ব্যবহার, রাজনৈতিক সমাবেশ, ওপেন কনসার্ট, ভবন নির্মাণ, জেনারেটর, কারখানা থেকে নির্গত উচ্চ শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রান্সপোর্ট ও এনভায়রনমেন্ট এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ৫ লক্ষ লোক রেল এবং সড়ক পরিবহন থেকে শব্দ দূষণের ফলে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক আক্রান্ত হয় এবং ২ লক্ষ লোক কার্ডিও-ভাস্কুলার রোগের শিকার হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কঠিন কিছু নয় সচেতনতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও আইনের প্রয়োগই পারে শব্দ দূষণ কমিয়ে আনতে।

প্লাস্টিক দূষণ: প্লাস্টিক দূষণ এখন কোনো নতুন বিষয় নয়। এক সময় প্লাস্টিক বলতে শুধু পলিথিন ব্যাগ, বোতল ইত্যাদিকে ধরা হতো, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে প্লাস্টিকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা বর্তমানে মাইক্রোবিডস নামে খুব পরিচিতি লাভ করেছে। ফেইসওয়াস, ডিটারজেন্ট, সাবান, বডিওয়াস, টুথপেস্ট ইত্যাদিতে প্রচুর মাইক্রোবিড পাওয়া যায়। প্লাস্টিক ও মাইক্রোবিডসের ফলে মানুষ থাইরয়েড, হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণ, কিডনি রোগ, চর্মরোগ ইত্যাদি সমস্যাতে ভোগে। এছাড়া এর কারণে সামুদ্রিক প্রাণির (তিমি, পাখি) খাদ্য চক্রে প্লাস্টিকের উপস্থিতি ও ভক্ষণের ফলে মৃত্যু হয়। নদী নাব্যতা হারায়, ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষিত হয়, মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ মাইক্রোবিডের উপর একটি গবেষণায় ৮ ধরনের ১০৪ টি প্রসাধনী সামগ্রীর মধ্যে ৫১ টিতে মাইক্রোবিডের উপস্থিতি পায়। প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করতে হলে প্রথমেই পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন ২০০২ বাস্তবায়ন করে প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাট, কাগজ, কাপড়ের তৈরি ব্যাগ (সোনালি ব্যাগ) ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহী করতে হবে। মাইক্রোবিড যুক্ত পণ্য নিষিদ্ধ করতে হবে।

নদী দূষণ: নদী দূষণের মূল কারণ ৭০-৮০ ভাগ শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে নদী কেন্দ্র করে। এছাড়া কারখানা শুধুমাত্র দিনের বেলায় ইটিপি চালু রাখে, পৌর কর্তৃপক্ষ পরিশোধন ছাড়া পয়ঃপ্রণালীর বর্জ্য নদীতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে নদী দূষিত হচ্ছে। ডকইয়ার্ডের বর্জ্য, নদী পথে চলাচলকারী জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলারের লিকেজের ফলে কয়লা ও তেল, আরোহী কর্তৃক কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃপ্রণালীর, কৃষিকার্যক্রমের ফলে আগত রাসায়নিক এবং নদীর পাশে গড়ে ওঠা জনমানুষের অপরিকল্পিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও গৃহস্থলী বর্জ্য, নদী দখল করে গবাদি পশুর বাসস্থান নির্মাণ ইত্যাদি ও নদী দূষণের জন্য দায়ী। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে। আইনের ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার দূষক নদীতে ছেড়ে দেয় তাহলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। নদী দূষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য নদী ও নদী পাড় হতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শিল্প বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি/সিইটিপি এবং সিউয়েজ বর্জ্যের জন্য এসটিপি ব্যবহার করতে হবে।

অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: যে কোনো এলাকার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট এর আবর্জনা, শিল্প কারখানা হতে উৎপাদিত আবর্জনা, মেডিকেল বর্জ্য, রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাটবাজারের পচনশীল শাকসবজি, কসাইখানার রক্ত, ছাপাখানার রঙ ইত্যাদি বর্জ্যের অন্যতম উৎস। বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মেডিকেল বর্জ্য। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখায় বাতাস ও মাটি দূষিত হচ্ছে, অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্য স্তূপীকরণের ফলে আশেপাশে দুর্গন্ধের পাশাপাশি দেখা যায় মশা, মাছি ও পোকামাকড়ের মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব। বর্ষা মৌসুমে বর্জ্যগুলোর অবস্থা হয় আরো ভয়াবহ। বর্ষা মৌসুমে সময় মত বর্জ্য অপসারন না করায় বর্জ্যসমূহে দ্রুত পচনপ্রক্রিয়া শুরু হয়, পঁচা বর্জ্য থেকে তরল, কালো রঙের দুর্গন্ধযুক্ত লিচেট (রস) তৈরি হয়। এই লিচেট বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদীনালাতে এবং মাটির বুনটের ফাঁকা স্থানের মধ্য দিয়ে গ্রাউন্ড ওয়াটারে গিয়ে মিশে গিয়ে ভ‚গর্ভস্থ পানি দূষিত করছে। ফলে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক জরিপে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন ১ দশমিক ৮০ টন থেকে ২ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৬৫ ভাগ বিপজ্জনক বর্জ্য। এসব বর্জ্য নাড়াচাড়ায় যারা জড়িত তাদের প্রায় সবাই কোনো ধরনের নিরাপত্তা উপকরণ যেমন: গ্লাভস, গামবুট, মাস্ক ইত্যাদি ব্যবহার ছাড়াই কাজ করে, যা কর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য দায়ী।

পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ সব দেশই চিন্তিত। সভ্যতার অস্তিত্বই আজ এক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেকোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন