ভয়াবহ দূষণের কবলে ঢাকার বাতাস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচক অনুযায়ী, বায়ু দূষণের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। গেল সপ্তাহজুড়েই রাজধানীর বায়ুর মান ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩৬ গুণ বেশি দূষিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর বাসিন্দারা। এ অবস্থায় দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শীতের শুরু থেকেই দ্রুত খারাপ হতে থাকে ঢাকার বায়ুর মান। গত কয়েক দিনে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ বেড়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বাতাস। গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার বাতাস ছিল বিশ্বের মধ্যে দূষণের দিক থেকে শীর্ষে। বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ওইদিন সকাল সোয়া ১০টায় রাজধানীর বায়ুর মান ছিল ৩৩৭, যা বায়ুমান সূচকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
গতকাল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২৩৮ নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। পাকিস্তানের লাহোর ও করাচি ২৬৪ ও ২১৮ একিউআই স্কোর নিয়ে যথাক্রমে তালিকার প্রথম ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০০ এর বেশি হলে সে বায়ু অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হয়। গত তিন চার দিন যাবত ঢাকার বাতাসের মান ২৩০ থেকে ৩৪০ এর মধ্যে উঠা নামা করছে। যার অর্থ হল বর্তমানে ঢাকার বাতাস খুব অস্বাস্থ্যকর না হলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর থাকছে। এতে বলা যায় নগরবাসীর চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।
অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, খোলা ট্রাকে মাটি-বালু পরিবহন, অবৈধ ইটভাটা, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল, ট্রাফিক জ্যামের কারণে দূষণ বাড়ছে। এসব নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, বায়ুদূষণ রোধে বিধি-মালা অনুযায়ী এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর বাতাস থেকে রক্ষা পেতে ঢাকাবাসীকে মাস্ক পরা ও ঘরে বায়ু বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণের সমস্যায় জর্জরিত। এর বাতাসের মান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। শীত আসার সাথে সাথে নির্মাণ কাজ, রাস্তা-ঘাট, ইট-ভাটা এবং অন্যান্য উৎস থেকে দূষক কণা ব্যাপকভাবে নিঃসরণের কারণে শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। এবার শীত আসতে না আসতেই ঢাকার বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে। তবে এ ব্যাপারে কতৃপক্ষ নিরব।
করোনা মহামারিকালে ঢাকার বায়ুরমান ছিল স্বাভাবিক। এরপর ২০২১ সালে আবার ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরের শুরুর দিকে অর্থাৎ জানুয়ারিতে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২৬৯ নিয়ে ঢাকা আবার বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে আসে। এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর ৩৩৭ স্কোর নিয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা আবার শীর্ষে উঠে আসে। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা তখন চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকেন।
বায়ুদূষণকে পরিবেশবাদীরা মানুষের নীরব ঘাতক হিসাবে অখ্যায়িত করেছেন। বায়ুদূষণ ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী মৃত্যু এবং বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টির শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয়ার ফলে মানুষের হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ ও ক্যান্সার হওয়ার শঙ্কা বৃদ্ধি পায়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ যেমন Ñস্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি সংগঠন হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের ‘এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড হেলথ ইন সিটিস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষিত বায়ুর কারণে ২০১৯ সালে রাজধানীতে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু তিন বছর কমছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িক ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে ‘পলিউশন অ্যান্ড হেলথ: আ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে শুধু বায়ু দূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন