বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের ওপর খুবই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণকারী ভাসমান খুদে কণা (পিএম২.৫)। দূষিত বায়ু মানুষের গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে দুই বছরের বেশি। তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের কারণেই বিশ্বব্যাপী বাতাসে ক্ষতিকর ভাসমান কণা যুক্ত হচ্ছে বেশি।
মঙ্গলবার (১৪ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট বলছে, বায়ুদূষণে আয়ু কমার দিক থেকে ওপরের সারিতে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ—ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তান। এর মধ্যে ভারতের রাজধানী প্রায়শই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তকমা পাওয়া নয়াদিল্লিবাসীর আয়ু কমছে ১০ বছর পর্যন্ত। এছাড়া বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় সাত বছর।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট বায়ুদূষণের ২৫ শতাংশ হয়ে থাকে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তান—এই চার দেশ থেকে। বাংলাদেশের গড় আয়ু সাত বছর হ্রাস হলেও রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের আয়ু কমেছে আট বছরের বেশি। আর দ্বিতীয় প্রধান নগর চট্টগ্রামবাসীর আয়ু কমেছে সাড়ে ছয় বছর।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বায়ুদূষণের নতুন মাত্রা নির্ধারিত করেছে। সে অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় বায়ুতে পিএম২.৫-এর ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম অথবা বছরজুড়ে প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে থাকতে হবে। এই মাত্রার মধ্যে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ার উল্লিখিত চার দেশের মানুষ গড়ে পাঁচ বছর বেশি বাঁচতে পারতেন।
এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ বায়ুদূষণ বেড়েছে, তার ৪৪ শতাংশই হয়েছে ভারত থেকে। বায়ুদূষণের কারণে দেশটিতে বছরে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। শীতকালে ভারতের শহরগুলো ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থাকে। এ সময় বায়ুতে ক্ষতিকর খুদে কণা পিএম২.৫ খুব উচ্চ মাত্রায় থাকে, যা ফুসফুসে আটকে যেতে পারে। দূষণের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উত্তর ভারতীয়রা। সেখানকার ৫০ কোটির বেশি মানুষের গড় আয়ু সাড়ে সাত বছর পর্যন্ত কমার দ্বারপ্রান্তে। বায়ুদূষণের বর্তমান মাত্রা অনুযায়ী, দূষণের নগরী খ্যাত দিল্লির বাসিন্দাদের অবস্থা আরও করুণ। সেখানকার নাগরিকদের গড় আয়ু কমতে পারে ১০ বছর পর্যন্ত। বর্তমানে দিল্লির বায়ুতে পিএম২.৫-এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০৭ মাইক্রোগ্রাম অতিক্রম করেছে, যা ডাব্লিউএইচও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ২১ গুণেরও বেশি।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের বায়ুতে পিএম২.৫-এর মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৯ সালে তা ছিল ৬৭ মাইক্রোগ্রাম। গত এক দশকে বাংলাদেশে দূষণের মাত্রা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এ সময় বাংলাদেশের বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রা ছিল ৬৩ থেকে ৭৭ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে, যা ডাব্লিউএইচও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ১২ থেকে ১৫ গুণ বেশি। ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের বায়ুতে দূষণকারী খুদে কণার পরিমাণ ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। দেশের ৬৪ জেলায়ই দূষণের মাত্রা ডাব্লিউএইচও নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করেছে।
এদিকে ২০২০ সালে নেপালের বায়ুতে পিএম২.৫-এর মাত্রা ছিল ৪৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম এবং পাকিস্তানে ছিল ৪৪ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। ডাব্লিউএইচও নির্ধারিত মাত্রা বজায় রাখতে পারলে এই দুই দেশের মানুষ গড়ে প্রায় চার বছর বেশি বাঁচতে পারতেন।
গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, গত দুই দশকে শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে জ্বালানির আকাশচুম্বী চাহিদা বেড়েছে। ২০০০ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তানে মোটরযানের পরিমাণ চার গুণ বেড়েছে। এদিকে বাংলাদেশে গত এক দশকে মোটরযান বেড়েছে তিন গুণ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালে জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিন গুণ বেড়েছে। ইটখোলা এবং শিল্পায়নের অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য এই অঞ্চলের বায়ুতে ক্ষতিকর খুদে কণার পরিমাণ বেড়েছে।
বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছে চীন। ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে বায়ুদূষণ কমেছে ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ। আর ২০১৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত কমেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। মাত্র সাত বছরে বেইজিংয়ের বায়ুতে পিএম২.৫-এর মাত্রা ৮৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে কমে ৩৮ মাইক্রোগ্রামে ঠেকেছে। ২০১৩ সালে দূষণের মাত্রা কমানোয় বর্তমানে চীনের মানুষের গড় আয়ু দুই বছর বেড়েছে।
সূত্র : বিবিসি ও এএফপি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন