২০ বছরে বায়ুদুষণজনিত রোগ বালাইয়ের কারণে মৃত্যু ৯ শতাংশ বেড়েছে। বায়ুদুষণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। ১৫ বছরে প্লাস্টিক দূষণও বেড়েছে দ্বিগুণ। এর ফলে ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে শহরাঞ্চলের মানুষ। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল ‘সবুজ শহর উদ্যোগ’ বিষয়ে আলোচনায় এ তথ্য তুলে ধরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকার বায়ুর মান খারাপ, অত্যন্ত খারাপ। বাতাসের মান উন্নয়নে ইটভাটা বন্ধের পাশাপাশি রাজধানীতে যানবাহন কমাতে স্কুলবাস চালুর বিকল্প নেই। বায়ুদুষণ বন্ধে নগরীতে যত্রতত্র নির্মাণ সামগ্রী রাখলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন-এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের জন্য শিল্পকারখানা নয়, ইট ভাটা এবং যানবাহনের ধোঁয়া বেশি দায়ী। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা উল্লেখ করে এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের বর্জ্যব্যবস্থাপনা গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। না নিতে পারলে দূষণ আটকানো যাবে না। শহরে বাইরে দেখা যায় রাস্তার পাশে বর্জ্যরে স্তূপ। ওখানে তো বর্জ্য রাখার কথা নয়। আর একটি হচ্ছে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা। খাল-বিল বন্ধ করে রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। এক সময় ব্রিজ ছিল, রাস্তার সুবিধার জন্য কালভার্ট করে চিরদিনের জন্য নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেওয়া ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই। পার্টনারশিপের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে।
বায়ু ও প্লাস্টিকের দূষণ বন্ধে সঠিক নীতি গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি এবং সরকারের শক্ত অবস্থানের ওপর জোর দেন আলোচকরা। অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সেমিনারটি পরিচালনা করেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক সৈয়দ ইউসুফ সাদাত।
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বায়ুদূষণের সমস্যায় জর্জরিত। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে চরম অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। শীত আসার সাথে সাথে নির্মাণ কাজ, রাস্তাঘাট, ইটভাটা এবং অন্যান্য উৎস থেকে দূষক কণা ব্যাপকভাবে নিঃসরণের কারণে শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারিকালে ঢাকার বায়ুরমান ছিল স্বাভাবিক। এরপর ২০২১ সালে আবার ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরের শুরুর দিকে অর্থাৎ জানুয়ারিতে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২৬৯ নিয়ে ঢাকা আবার বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে আসে। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা তখন চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকেন।
বায়ুদূষণ মানুষের এক নীরব ঘাতক। বায়ুদূষণ ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী মৃত্যু এবং বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টির শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয়ার ফলে মানুষের হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ ও ক্যান্সার হওয়ার শঙ্কা বৃদ্ধি পায়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ যেমন- স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি সংগঠন হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের ‘এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড হেলথ ইন সিটিস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষিত বায়ুর কারণে ২০১৯ সালে রাজধানীতে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু তিন বছর কমছে।
বায়ুদূষণের পাশাপাশি প্লাস্টিক দূষণও মহামারি আকার ধারণ করেছে। উৎপাদন, বিপনন, ব্যবহার নিষিদ্ধ; অথচ সবার হাতে হাতে পলিথিন। নিত্যদিনের বাজার সদাই মানেই পলিথিনের ব্যবহার। নিধিদ্ধ পলিথিনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশের। দোকানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে পলিথিনের স্তুপ, আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতেও শোভা পায় পলিথিনের ব্যাগ। অথচ আইন করে সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনের কঠোর ব্যবহারে ২০০২-৩ সালেও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ সালের পর ক্রমান্বয়ে পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে যায়।
পলিথিন ও বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহারে সারাদেশে খাল-বিল, নদী-নালা থেকে শুরু করে সমুদ্র্র পর্যন্ত প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। সেই সাথে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র। প্লাস্টিক শুধু আসবাবপত্র বা পলিথিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে নামিদামি কসমেটিক কোম্পানির সাবান, ফেসওয়াস, টুথপেস্ট, বডিওয়াস, ডিটারজেন্ট, বিস্কিট , চানাচুর, চিফস, মশলা ইত্যাদিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যাদির মোড়কে মাইক্রোবিড নামকক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি দেখা যায়। যা ব্যবহারের পর নদী-নালা, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে যাচ্ছে এবং মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। আর এর ফলে চর্মরোগসহ মারাত্মক ক্যান্সার পর্যন্ত হচ্ছে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন-এসডো এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৯২ হাজার ১০৪ টন পরিমাণ প্লাস্টিকের স্যাশে বা মিনিপ্যাক-বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মানুষ দিনে প্রায় ১২ কোটি ৯০ লাখ প্লাস্টিকের স্যাশে ব্যবহার করে। ২০২১ সালের ২১ জুন থেকে ২০২২ সালের ২২ মে দেশে প্রায় ১০ লাখ ৬ হাজার টন ওয়ানটাইম বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। এসডোর সভাপতি সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, প্লাস্টিকের মিনি প্যাকেট পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। প্লাস্টিকের মিনি প্যাকেট আকারে ছোট হলেও পরিবেশে এর প্রভাব বিশাল। তিনি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারে বিশেষ করে স্যাশে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে বিধিনিষেধ কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন