রাজধানী ঢাকায় নাগরিকদের বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সব সময়ই রাজধানীবাসী সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। গ্রীষ্মে প্রচÐ গরম, আর বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তা-ঘাট পানিতে ডুবে নাগরিকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। শীতে বায়ুদূষণ, নদীদূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এছাড়া বছরজুড়েই অসহনীয় যানজট, মশার উপদ্রব, গ্যাস সঙ্কট, পানি সঙ্কট এসব নানান নাগরিক বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগে ঢাকা এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মেগাসিটি ঢাকা ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি জনসংখ্যার চাপে ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। গত এক দশকে রাজধানী ঢাকার বাসযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরগুলোর র্যাংকিংয়ে ঢাকার অবস্থান একেবারে নিচের দিকে। গতবছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম। অর্থাৎ ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ৭ম। পর্যাপ্ত রাস্তা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি লক্ষ্য না রেখে বছরের পর বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার কারণেই ঢাকা এখন বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
এক সময়ের তিলোত্তমা নগরী রাজধানী ঢাকার বাতাস এখন বিষাক্ত। এ নগরী এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর হিসাবে পরিচিত হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত একদিনও বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি ঢাকাবাসী। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২৮৯ নিয়ে গতকালও ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানে। এই স্কোরে বাতাসের মান খুবই অস্বাস্থ্যকর। এর আগের দুই দিনও ঢাকা ছিল দূষিত শহরের শীর্ষে। যদিও এই তালিকা ওঠানামা করছে। তবে চলতি মাসে ঢাকা প্রায় ১৫ দিনই ছিল দূষণের শীর্ষে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে গতকাল ঢাকার পরে ভারতের দুই শহর দিল্লি ও মোম্বাইয়ের অবস্থান। তাদের স্কোর যথাক্রমে ২৭০ ও ১৮৬। এর পরে ১৭৬ স্কোর নিয়ে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশবেক। পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে চীনের দুই শহর উহান ও চংগিং। তাদের স্কোর যথাক্রমে ১৭৫ ও ১৭৩।
চলতি বছরের শুরুর দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি একিউআই স্কোর ১৭৭ নিয়ে ঢাকা ছিল বিশ্বের দূষিত বাতাসের তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থানে। ২ ও ৩ জানুয়ারি ২০২ ও ২০১ স্কোর নিয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল দ্বিতীয় স্থানে। এরপর ৪, ৫, ৬, ৮, ১১ এবং ১৩ জানুয়ারি ঢাকা ছিল বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের শীর্ষ স্থানে। এর মধ্যে ৫ এবং ১৩ জানুয়ারি বাতাসে একিউআই স্কোর ছিল ৩০১ ও ৩০৬। ৯ এবং ১০ জানুয়ারি ঢাকা ছিল দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় তৃতীয় স্থানে এবং ৭ জানুয়ারি ছিল চতুর্থ স্থানে। বিশ্বে বায়ু দূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বারবার শীর্ষে উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের পরিমাণ বছরে ১০ শতাংশ করে বেড়ে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে ঢাকা। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠে এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার বায়ু দূষণের ৩ প্রধান উৎস ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ স্থানের ধুলা। এর সঙ্গে শিল্পকারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ধোঁয়ার মিশ্রণ হলে দূষণ আরও ভয়াবহ হয়।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় যানবাহনগুলো প্রতিদিন ১০০ কেজি সিসা ১ দশমিক ৫ টন সালফার-ডাইঅক্সাইড, ৬০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত করে। এসব উপাদান ক্রমাগত বাতাসের সঙ্গে মিশছে। সেই বাতাস আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে য²া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হাঁপানি প্রভৃতি মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে।
শুধু বাতাস নয় রাজধানী ঢাকার পানি ও শব্দদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ঢাকা মূলত নদী কেন্দ্রিক শহর। রাজধানী এই শহর বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এ ছাড়াও এ নগরীকে ঘিরে রয়েছে তুরাগ ও বালু নদী। বর্তমানে ভয়াবহ দূষণে এসব নদীর পানি দুর্গন্ধময় কাল রঙ ধারণ করেছে। নদীতে কোনো প্রবাহ নেই। নদীগুলো এখন মৃতই বলা চলে। আসলে নদী যদি না বাঁচে তাহলে নদীকেন্দ্রিক এই শহরও প্রাণহীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজধানী স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে সব দূষণ কয়েক গুণ ছাড়িয়ে গেছে। পরিবেশের অস্বাভাবিক দূষণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। নানামুখী দূষণে মানুষের শ্রবণশক্তি ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জি সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকিও। বর্তমানে ঢাকা দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং দ্রæত হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সবধরনের দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। কারণ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নগরীর মানুষ স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। স¤প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামসুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, বায়ু ও পানিদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। পানিদূষণ সংক্রামক রোগের পাশাপাশি অসংক্রামক রোগের বিস্তারে সমানভাবে দায়ী। যানবাহন ও কলকারখানা থেকে মারাত্মক বায়ুদূষণের সৃষ্টি হয়। এ কারণে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বায়ুদূষণে অ্যালার্জি জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এমনকি বায়ুদূষণের কারণে ছড়িয়ে পড়তে পারে ক্যান্সারের মতো রোগ।
রাজধানীতে শব্দদূষণ মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও সাহিকসহ (সোসাইটি ফর অ্যাসিস্ট্যান্স টু হিয়ারিং ইম্পেয়ার্ড চিলড্রেন) বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান শব্দদূষণের মাত্রা পরিমাপ করে। পরিবেশ অধিদফতর ঢাকা শহরের ৭০টি স্থানে দুটি কর্মদিবস ও একটি ছুটির দিনে পিক ও অফ-পিক আওয়ারে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। অধিদফতরের বিধিমালা অনুযায়ী রাতে শব্দের মানমাত্রা সর্বনিম্ন ৪০ ডেসিবল এবং সর্বোচ্চ ৭০ ডেসিবল নির্ধারণ করা হয়। সে হিসেবে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে দেখা যায়, ঢাকায় নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে।
মশার উপদ্রবে রাজধানীবাসী অতিষ্ঠ। মশার কারণে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে। মশা বৃদ্ধি পাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন ডোবানালা ও খালে। ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে ঢাকার খালগুলো। রাজধানীর খাল রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও এর সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। সংস্কারের পর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে ফের ভরাট হয়ে পড়ে খাল। আর অনেক জায়গায় সেই সুযোগ কাজে লাগায় অবৈধ দখলদাররা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার খাল ভরাট ও বেদখলের ফলে পানিবদ্ধতা এবং পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। তা ছাড়া যানজট নিরসনে নৌ-রুট প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনাও ভেস্তে যাচ্ছে। ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে নেয়ার পর সিটি করপোরেশন নিজস্ব ফান্ড থেকে অনেক খাল পরিষ্কার করে। কিন্তু সেসব খাল আবারও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
গ্যাসের সংকটে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় দিনের বেলায় জ্বলছে না রান্নার চুলা। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ সময়ে গ্যাস তেমন কাজে লাগছে না। অনেকেই এখন পাইপলাইনের গ্যাসের পাশাপাশি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। এতে পরিবারের খরচ বেড়েছে। তবে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। কিছুদিন আগেও সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যেত। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ভোর পাঁচটার পরই গ্যাসের চাপ কমে যায়। যে চাপ থাকে, তাতে চুলা নিবু নিবু করে জ্বলে, রান্না করা যায় না।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব ইনকিলাবকে বলেন, একটি নগরীকে বাসযোগ্য করে গড়তে হলে সঠিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। ঢাকা নগরী অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এ নগরীতে পর্যাপ্ত রাস্তা ঘাট নেই। নেই খেলার মাঠ, পার্ক, বাগান। নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও খুবই দুর্বল। নগরীর পরিবেশ প্রতিনিয়তই নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। তাই এই নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে এখনই যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে আলোকে কাজ করতে হবে। সরকার সে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন