বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

নাগরিক ‘যন্ত্রণার’ নগরী

বায়ুদূষণে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:৫৪ এএম

শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সঙ্কট, যানজট, যত্রতত্র আবর্জনা, খাবারে ভেজাল, নকল পণ্য, যানবাহনের অতিরিক্ত ভাড়া, বৃষ্টি হলেই সড়কে হাঁটু
পানি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবন
স্টাফ রিপোর্টার
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা হওয়ায় সবাই ঢাকামুখী। সারাদেশের মানুষ মনে করেন সব সুযোগ-সুবিধার শহর রাজধানী ঢাকা। ঢাকায় এলেই চাকরি, চিকিৎসা, লেখাপড়া সহজ হবে। ‘ঢাকার মানুষ সুবিধাভোগী’ গ্রামগঞ্জের মানুষ এমন ধারণাই পোষণ করেন। অথচ ঢাকা শহর ক্রমেই বসবাসের অনোপযোগী হয়ে পড়ছে। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশনকে দুইভাগে বিভক্ত করা হলেও সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, যানজট, পানির অভাব, বিদ্যুতের লোডশেডিং, গ্যাসের অভাব সবকিছুই নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।

গতকালও বায়ুদূষণে বিশ্বের প্রায় শীর্ষ অবস্থানে ছিল ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকার অবস্থান।
নানা সমস্যার পাহাড় জমে রীতিমতো নাগরিক দুর্যোগের অপর নাম হচ্ছে ঢাকা শহর। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, পরিবেশের বিপর্যয়, খাদ্য ও পণ্যসামগ্রীর ভেজালে ঢাকাবাসীর জীবন শঙ্কিত করে ফেলেছে। তার ওপর চলতি পথে যানজট, গ্যাস স্বল্পতায় টিমটিম চুলা, পানির জন্য হাহাকার, ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধময় রাস্তাঘাট, মেরামতের নামে নগরজুড়ে রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি, উন্নয়নের ধকল, পানিবদ্ধতা, একদিকে যানবাহন সঙ্কট অন্যদিকে লাখ লাখ রিকশার রাজত্ব, ভাড়া নিয়ে হট্টগোলসহ ঘর থেকে বেরুলেই আরো শতেক জঞ্জাল-যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয় নগরবাসীকে। সবমিলে দুর্বিষহ ঢাকার জীবন। ভৌত অবকাঠামোগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, শিক্ষা, আবাসন, পরিবহনসহ সব সেক্টরেই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।

শব্দদূষণ নিয়ে এখন আর তেমন উচ্চবাচ্য নেই। যানজট নিরসনে নানান পদক্ষেপের কথা বলা হলেও এক সময়ের মসজিদের শহর ঢাকা এখন কার্যত যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে। মাসের পর মাস ধরে গ্যাস সঙ্কট। হাজার হাজার ঘরে চুলা জ্বলে না। একই চিত্র বিদ্যুতের। সরকার এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দিলেও দিনে কয়েকবার করে বিদ্যুৎ থাকে না।

সড়কে যানজট অথচ পথচারীদের চলাচলের যাওয়াও নেই। ফুটপাত হকারদের দখলে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাঁদাবাজির দখলদারিত্বে গোটা রাজধানীজুড়েই তৈরি হয়েছে হাট-বাজার। পুরান ঢাকার নর্থ-সাউথ রোডের অর্ধেকটা অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে সংলগ্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। সিদ্দিকবাজার থেকে ইংলিশ রোডের মোড় পর্যন্ত সড়কে রড-সিমেন্ট, আসবাবপত্রের দোকানের মালামাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। সেখানে মাত্র ৩/৪ হাত সড়ক ফাঁকা রেখে মালামাল লোড-আনলোডের জন্য পাশেই পার্কিং করা থাকে সারি সারি মিনিট্রাক, ঠেলাগাড়ি। রাস্তা দখল করে রাখার জন্য কোনো যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। কমলাপুর স্টেডিয়াম থেকে মুগদা-বৌদ্ধমন্দির গেট পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যস্ততম বিশ্বরোডে দুই সারিতে গাড়ি রাখা হয়। বিভিন্ন কাউন্টার সার্ভিস বাস, কোচ, ট্রাক, লং ট্রেইলারসহ পণ্যবাহী গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে পার্কিং করে রাখায় ওই চার কিলোমিটার এলাকা দিনভর ভয়াবহ যানজট লেগে থাকে। নিউ মার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকার ফুটপাত আর ফুটওভার ব্রিজজুড়ে রয়েছে হকারদের আধিপত্য। দোকান বসিয়ে পুরো ব্রিজকেই বাজার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। মিরপুর রোড তথা নিউ মার্কেট ও গাউসিয়া মার্কেটের মাঝামাঝি রাস্তায় সারাক্ষণই ময়লা-আবর্জনার স্ত‚প পড়ে থাকে। বঙ্গবাজারের সামনে থেকে শুরু করে গুলিস্তান-কাপ্তানবাজার পর্যন্ত রাস্তাটি ডাস্টবিন, বাজার, নাকি টার্মিনাল তা বোঝা মুশকিল।

বিশ্বের অন্যতম বায়ুদূষণের শহর হচ্ছে ঢাকা। গত কয়েক দিন মৌসুমি বায়ুর কারণে টানা বৃষ্টি হওয়ায় দূষণ কিছুটা কম হলেও গতকাল বুধবার দূষণে ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে।
ঢাকা দূষণের মান ১৫৩, যা মাত্রার দিক থেকে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় আছে। এদিকে প্রথম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর, যার মাত্রা ১৬১। তৃতীয় অবস্থানে আছে দুবাই, একিউআই সূচক ১৫২।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সের বায়ুদূষণের হিসেব অনুযায়ী সাধারণত ৫০ থেকে ১০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোরকে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ বলা হয়। তবে কিছু মানুষের জন্য এটাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে যারা বায়ুদূষণের প্রতি অস্বাভাবিকভাবে সংবেদনশীল। বিশেষ করে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য একিউআই স্কোর ১০১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করা হয়।

বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘বছরের জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে অন্য সময়ের চেয়ে বাতাসের মান সাধারণত ভালো থাকে। সারা বছরের মাত্র ১৫ ভাগ বায়ুদূষণ হয় এই চার মাসে। তবে এবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেরি করে। ফলে প্রথম দুই মাসের দূষণ আগের চেয়ে বেশি ছিল। এখন মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ায় দূষণের মাত্রা কমে এসেছে। তবে আগের কয়েক দিন যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, সে তুলনায় এখন বৃষ্টি কম। তাই দূষণ আবারও বাড়ছে। কারণ, দূষণের জন্য দায়ী যেসব বিষয়, যেমনÑ যানবাহন চলাচল, শিল্প কারখানার দূষণ, ইটভাটা, নির্মাণকাজ কিছুই কিন্তু থেমে নেই।

রাজধানীতে চলাচলকারী সবধরনের যানবাহনের ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। তারপরও কর্মজীবীদের প্রধান সমস্যা এখন নির্বিঘেœ যাতায়াত। ভয়াবহ যানজট এখন নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, মেরামতের নামে নগরজুড়ে রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি, উন্নয়নের নামেস বিভিন্ন নির্মাণ কাজের ধকল, যাত্রী তুলনায় যানবাহনের তীব্র সঙ্কট, ভাড়া নিয়ে নিত্য হট্টগোলসহ নানা কারণেই যাত্রী-পথচারীরা প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। দুঃসহ যানজটে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকা অবরুদ্ধ হয়ে থাকছে। স্থবির হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। নগরীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে যাতায়াতে পুরোটা দিন লেগে যায়। বাস-মিনিবাস, প্রাইভেটকার, রিকশা ব্যবহার করেও কতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছবেন তা কেউ হলফ করে বলতে পারেন না। রীতিমত অনিশ্চিত যাত্রা।

রাজধানীজুড়েই এখন গ্যাসের সঙ্কট। কোনো এলাকায় দুপুরের পর গ্যাস আসে। আবার কোনো কোনো এলাকায় আসে রাতে। যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, মুগদা, বাসাবো, সবুজবাগ এলাকায় বাসিন্দাদের রান্না করতে হয় গভীর রাতে। রাত ছাড়া গ্যাসের দেখা মেলে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে বহুতল ভবনের বাসিন্দারা।
গ্যাসের মতো পানির দামও বেড়েছে। কিন্তু নাগরিকরা প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেন না। বর্ষাকালের কিছুদিন পানি সঙ্কট কম থাকলেও সারাবছরই রাজধানীবাসীকে পানি সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। এর সাথে কোনো কোনো এলাকায় ড্রেনের পানি ওয়াসার লাইনে ঢুকিয়ে দেয়ায় দুর্গন্ধযুক্ত পানি বের হচ্ছে। এ পানি ফুটালেও দুর্গন্ধ দূর হয় না। অথচ সেই পানি পান করতে হচ্ছে।

নগরীর প্রধান প্রধান রাস্তার ওপরে যেন সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে রীতিমত ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় বসানো হয়েছে। একেকটি স্থানে ৭/৮টি করে কনটেইনার টার্মিনাল বসিয়ে অলিগলি, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা তুলে এনে সেসব কনটেইনার ডাস্টবিনে রাখা হচ্ছে। ঢাকার শহরে কোন খাদ্যজাতদ্রব্যটি ভেজালমুক্ত তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। চাল, ডাল, তেল, সাবান, আটা থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল। এ ছাড়া ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নকল হচ্ছে। টাকা দিয়ে কিনতে গিয়ে আসল নকলের বিভ্রান্তিতে ভুগছে মানুষ। ফরমালিনযুক্ত মাছ আর কার্বইডযুক্ত ফল খেতে খেতে নগরবাসী যেনো অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যা পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর পাশাপাশি আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পরিবেশ সম্পর্কিত যেসব আইন রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন