বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, যে ব্যাক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে , সে তাদের দলভুক্ত বলে গন্য হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ’নং ৪০৩১)
সাম্প্রতিক কয়েক বছর আগে থেকে দেখতে পাচ্ছি যে, কিছু নামধারি বুদ্ধিজীবি মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্যেশ্যে পোষ্টার এবং বিলবোর্ড সহ মৌখিক প্রচার প্রচারনাতেও সামিল করছে একটি অগ্রহনযোগ্য বাক্য। তা হলো, “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” বাক্যটি কতখানি যৌক্তিক আর কতটুকু মুসলিম বিদ্বেষী তা নিয়ে সামান্য আলোচনা করতেই আজকের কলাম। শুরুতে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন তাহলো, বাক্যটি যেহেতু ধর্ম কেন্দ্রীক তাই এর বিচার বিশ্লেষনও ধর্মীয় চিন্তার আলোকেই করতে হবে। তবে ইতিমধ্যেই একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, উল্যেখিত বাক্যটির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় দূর্গা পূজার সময়। এযাবত আমরা কখনও মুসলমানদের ঈদুল আযহার সময় এ বাক্য কোন হিন্দু ভাইকে ব্যবহার করতে দেখিনা। বরং এবছরও ঈদুল আযহার সময়, ভারত সহ বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলো আওয়াজ তুলেছিল যে, মুসলমানদের জন্য গরু কুরবাণী নিষিদ্ধ করা হোক। এতে আমরা যতটুকু বুঝি তা হলো, এ বাক্য শুধু মুসলমানদেরকে হিন্দুদের ধর্মে যুক্ত করার জন্য অন্য ধর্মের মানুষকে ইসলামের উৎসবে অংশগ্রহনের জন্য নয়। আর ইসলাম এ অনুমতিও দেয়নি যে মুসলমানদের কোন ধর্মীয় উৎসব সব ধর্মের মানুষদের কে নিয়ে পালন করা যাবে। বরং ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। অন্য ধর্মের মানুষ কেন বিশদ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সমর্থ্য থাকা সত্বেও কুনবানি করলো না সে যেন ঈদগাহে না আসে। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, হাকেম)
উক্ত হাদিস থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব তাদের জন্য, যারা আল্লাহর হুকুম মান্য করবে এবং রাসুলুল্লাহর আদর্শ মত চলবে। অর্থাৎ মুসলমানদের কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিছক আনন্দ উৎসব নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে মহান আল্লাহর ইবাদত। সুতরাং ইবাদতে তারাই শরীক হবে যারা আল্লাহর হুকুমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল । যে ব্যক্তি মহান আল্লাহকেই মানেনা সে তো দুরের কথা যে ব্যক্তি আল্লাহকে মানে কিন্তু হুকুমের প্রতি অমনোযোগী সেও এই আনন্দে শরীক হতে পারবেনা। এখানেই শেষ নয়, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব স্বতন্ত্র ধারার অধিকারী। যার প্রমাণ মিলে বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত থেকে। যা তিনি দিয়েছিলেন হিজরতের পরে, সাহাবারা ইহুদীদের দুটি বড় উৎসব নওরোজ এবং মেহেরজান দেখে যখন শরীক হতে চাইলেন তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না আমি চাই মুসলমানদের দর্মীয় উৎসব হবে সতন্ত্র। তারই প্রেক্ষীতে আল্লাহ তায়ালা দুই ঈদ মুসলমানদের উৎসব হিসেবে দান করেন। যেখানে আনন্দ এবং আখেরাতের কল্যাণ উভয়টি নিহিত রয়েছে। (মিশকাত ১৪৩৯)
অন্য ধর্মের সাথে সাদৃশ্যে নিষেধাজ্ঞা : মুসলিমদের শ্রেষ্ঠ্যত্ত¡ বিবেচনা করে মুসলমানদের কাজ অন্য ধর্মের লোকদের কর্মের সাথে না মিলে, সে জন্য বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। মদীনায় আগমনের পরে, যখন দেখলেন ঈহুদীরা মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখে, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, আমরা আমাদের নবী মূসা আঃ এর মুক্তির দিনকে স্বরন করে রোজা রাখি। বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমরা তাদের থেকে এ রোজার ব্যপারে বেশি হকদার। কেননা মূসা আঃ আমার ভাই। সেই থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষনা করলেন, তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো। তবে আগে অথবা পরে একদিন মিলিয়ে নাও যেন ঈহুদীদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।(ইবনে খুজায়মা) অন্য হাদিসে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোসনা করেন, যে ব্যক্তি অন্য জাতীর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে আখেরাতে তাদের দলভুক্ত হবে। (আবু দাউদ) এছাড়াও পবিত্র কুরআন এবং বিভিন্ন হাদিসে এ ব্যপারে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারলাম যে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে কারও কোন অংশ নেই। এখন আলোচনা করবো অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে মুসলমানদের অংশগ্রহনের ব্যাপারে।
অন্য ধর্মের ধর্মীয় কাজে মুসলিমদের অংশ গ্রহনের বিধান : মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মের লোকদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ব্যপারে হযরত উমার রাঃ এক বর্ণনায় বলেন, তোমরা আল্লাহর দুশমনদের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহন থেকে বেঁচে থাকো। (আসসুনানুল কুবরা ১৮৮৬২) এর ব্যাখ্যায় ভিন্ন হাদিসে তিনি বলেন, কেননা এক্ষত্রে আল্লাহর অসন্তষ্টি নাযিল হয়। অন্য বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বিশ্বনবী হযরত মুহম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বলেন, যারা বিধর্মীদের মত উৎসব করবে, কিয়ামত দিবসে তাদের হাশর ঐ লোকদের সাথেই হবে। (আসসুনানুল কুবরা, হাদিস ১৫৫৬৩)
এছাড়াও আমরা যদি কোন বিধর্মীদের ধর্মীয় উৎসবের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পারি যে, সেসব উৎসবে এমন কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়, যা মহান আল্লাহর সাথে সরাসরি র্শিক। যেমন দূর্গাপুজার বিষয়টিই আলোচনা করা যাক, যেহেতু এ বিষয়টি আমাদের সমাজে পরিচিত। দূর্গাপুজা অর্থই হলো দূর্গা একটি প্রতিমা যার উপাসনা করাকে দূর্গাপুজা বলা হয়। এখন বলেন তো আমি মুসলিম হয়ে কিভাবে দূর্গাপুজায় যেতে পারি তাদের আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারি ? আমি মুসলমান মানে হলো আমি বিশ^াষ করি আল্লাহ এক, তার কোন শরীক নেই। আর আমার চোখের সামনে আল্লাহ ভিন্ন কোন খোদার ইবাদত করা হচ্ছে আর আমি সেখানে আকাত্ত¦তা ঘোষনা করছি তাহলে কিভাবে আমি মুসলমান থাকলাম ? সাধারণ বিবেকও সায় দেয়না। পক্ষান্তরে এটি এমন একটি পুজা যার বিরোধীতায় আমাদের প্রিয় নবী নিজের জিন্দেগী উৎসর্গ করে দিয়েছেন। আমিতো সেই নবীর উম্মত হয়ে যদি দূর্গা পুজাতে অংশগ্রহন করি তাহলে আমি কিভাবে নবীজির উম্মত পরিচয় দেই? মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করনা। কেননা র্শিক হলো বড় জুলুম। (সুরা লুকমান, আয়াত ১৩) অমুসলিম দের আচার অনুষ্ঠানে তখন মানুষ যায়, যখন তাদের সাথে বন্ধুত্ত¡ করে, আল্লাহ তায়ালা কোন অমুসলিমকে বন্ধু বানানোর ব্যপারে বলেন, হে ঈমানদারগন তোমরা আমার শত্রু এবং তোমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করোনা । ( সুরা মুমতাহানাহ, আয়াত ১)
পুজার প্রসাদ খাওয়ার হুকুম : আরও একটি বিষয় আমরা লক্ষ্য করে থাকি যে, কিছু আবেগী মুসলমান অমুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেতো যায়ই, আবার তাদের পুজার প্রসাদও খায় । এব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য হলো, যাওয়া ও একাত্ত¡তা ঘোষনা করা যেমন র্শিক। তেমনি তাদের প্রসাদ খাওয়াও হারাম। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শুকরের গোশত, এবং সেসব জীব জন্তু যা আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারও নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয় তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যান্ত দয়ালু। (সুরা আল বাকারা- আয়াত ১৭৩) সুতরাং কোন মুসলিম এর জন্য পুজার অনুষ্ঠানে সাহায্য করা, অংশ গ্রহন করা মেলায় যাওয়া , মেলা থেকে কোন কিছু কেনাকাটা করা সবই কুফরী । আল্লাহ মাফ করুন।
তবে কোন মুসলিম যদি রাষ্টীয় দ্বায়িত্বশীল হন তাহলে তার রাষ্টীয় দ্বায়িত্ব হিসেবে এর সঠিক ভাবে পালনের ব্যবস্থা করা, কারও পাহারীদারির দ্বায়িত্ব পরলে তার জন্য তা পালন করা জরুরি । এ ক্ষেত্রে তার কোন গুনাহ হবেনা। কেননা ভিন্ন ধর্মের মানুষদের জন্য তাদের নিজস্ব পরিধির মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা তাদের অধিকার। আর এ অধিকার ইসলাম অবশ্যই সমর্থন করে। বিভিন্ন সময় ইসলামি খেলাফত কালীনও এর অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কোন মুসলমানের জন্য এটির অনুমোদন নাই যে, যোগসাজসে বিধর্মীদের আচার অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করবে এবং একাত্ত¡তা ঘোষনা করে বৈধ করার জন্য অবৈধ বাক্য ব্যবহার করে বলবে যে ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আর সেই সুযোগে মুসলিম যুবকগন দূর্গাপুজায় যেয়ে হিন্দু মেয়েদের রমাঞ্চকর নাচ দেখবে আর উল্লাস করবে তা কখনও ইসলাম সমর্থন করেনা। বরং রিতিমত তা মুসলিম সমাজ ধ্বংসের কারন এবং যুব সমাজের চরিত্র নষ্টের কারন। কেননা তাদের ধর্মে যা পূণ্য ইসলামে তা বড় অপরাধ। তাহলে তাদের টা তাদের কাছে নেকী হলেও ইসলামে তা গুনাহ। তাই আসুন এই মারত্নক অনৈতিক কর্মকান্ড সম্বলিত বাক্য পরিহার করে আওয়াজ তুলি - ধর্ম যার উৎসবও তার, সব উৎসব সবার নয়।আল্লাহ কবুল করুন। আমিন
লেখক : সাংবাদিক, ইসলামি গবেষক ও কলামিষ্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন