পূর্বের আলোচিত বিষয়গুলোতে হুজুর (সা.)-এর সম্পদ ও আর্থিক অবস্থার বিভিন্ন দিকের ওপর সামান্যই আলোকপাত করা হয়েছে। এ বিস্তর-বিশাল দিকটিকে যথাযথভাবে তুলে ধরা সুকঠিন ও অসম্ভব। তথাপি তাঁর পার্থিব জবিনে বিশেষতঃ মাদানী জীবনের দশ বছর সময় আর্থিকভাবে কেমন কেটেছে, তারও একটি অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা প্রয়োজন।
দুনিয়ার প্রচলিত নিয়মে রাজা-বাদশাহ রাষ্ট্র-সম্রাজ্যের অধিকারী কিংবা বিশাল সম্পদ-অট্টলিকা ও ধন দৌলতের মালিক। ধনী বলতে হুজুর (সা.)-ই ছিলেন দোজাহানের শাহেনশাহ। শবে মে’রাজে রহস্যময় সিন্ধুকের ঘটনা তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। দুনিয়াবি ও পার্থিব সম্পদের অধিকারী তিনি কিভাবে কতটুকু হয়েছিলেন, তা মুসলমানদের ‘গণিমত’-এর (যুদ্ধ লব্ধ) মাল হতে আন্দাজ করা যায়।
সূরা আনফালে বলে দেয়া হয়েছে : আরো জেনে রেখ যে, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ করো তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, ইয়াতীমদের, মিসকীনদের এবং পথচারীদের। (আয়াত- ৪১)।
গণিমতের মাল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত বিষয়। আভিধানিক অর্থে গণিমত বলা হয় সে সমস্ত মাল-সামানকে যা শত্রæর নিকট থেকে লাভ হয়। শরীয়তের পরিভাষা অনুযায়ী, অমুসলিমদের নিকট থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহে বিজয়ার্জনের মাধ্যমে যে মালামাল অর্জিত হয়, তাকেই বলা হয় ‘গণিমত’। আর যা কিছু আপোষ সন্ধি-সম্মতির মাধ্যমে অর্জিত হয় যেমন, জিযিয়া কর, খাজনা, ট্যাক্স প্রভৃতিকে বলা হয় ‘ফায়’। সূরা আনফালের বর্ণিত আয়াতে সে গণিমতের মালামালের কথা এবং তার বিধি-বিধান এবং বণ্টন পদ্ধতি বলা হয়েছে। এ গণিমতের মালামালের এক পঞ্চমাংশের মালিকানা হুজুর (সা.)-কে প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্য গণিমতকে হালাল করেছেন।’
পবিত্র কোরআনে ‘আনফাল’ অর্থে গণিমতকে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু গণিমতের এক পঞ্চমাংশের মালিক আল্লাহ তাআলা হুজুর (সা.)-কে করে দিয়েছেন, যাকে ‘খুমুস’ বলা হয়েছে। তাই আনফালের ব্যাখ্যাটি এখানে তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন হতে নিম্নে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে এ জটিল বিষয়টি সহজবোধ্য হয়। বলা হয়েছে:
‘আনফাল’ শব্দটি নফলের বহু বচন। এর অর্থ অনুগ্রহ, দান ও উপঢৌকন। নফল নামাজ, রোজা সাদকা প্রভৃতিকেও এ কারণে নফল বলা হয় যে, এগুলো কারো ওপর অপরিহার্য কর্তব্য ও ওয়াজিব নয়। যারা তা করে, নিজের খুশীতেই করে থাকে। কোরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় ‘নফল’ ও ‘আনফাল’ গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ মালামালকে বোঝানোর অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা যুদ্ধকালে কাফেরদের থেকে লাভ করা হয়। তবে কোরআন মাজীদে এতদর্থ তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। (১) আনফাল, (২) গণিমত এবং (৩) ফায়। আনফাল শব্দটি তো এ আয়াতে (সূরা আনফালের) শুরুতে রয়েছে। আর গণিমত শব্দ এবং তার বিশেষণ এ সূরার ৪১ তম আয়াতে আসছে, আর ‘ফায়’ এবং তার ব্যাখ্যা সূরা হাশরের আয়াত, ‘ওমা আফা আল্লাহু’ প্রসঙ্গে করা হয়েছে। এ তিনটি শব্দের অর্থ যৎ সামান্য পার্থক্যসহ বিভিন্ন রকম। (পৃষ্ঠা- ৫১৫) এ সম্পর্কে আরো বিবরণ রয়েছে।
আনফাল ও গণিমত সমার্থক, সে কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। ‘ফায়’ বলা হয় সে মালকে, যা কোনো রকম যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়াই কাফেরদের কাছ থেকে পাওয়া যায়, যেগুলো ফেলে কাফেররা পালিয়ে যায়, অথবা স্বেচ্ছায় দিয়ে দিতে রাজি হয়। ‘ফায়’-এর মাল বণ্টনের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ হতে রসূলুল্লাহ (সা.)-কে সমস্ত অধিকার প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং- গণিমতের খুমুস এবং ফায়-এর মালিকানা প্রাপ্ত হওয়ার পর পার্থিব দিক থেকে তিনি ছিলেন স্বচ্ছল, অভাবমুক্ত, ধনী। তবে ফায় এর মাল হতে তিনি তার পরিবার-পরিজনের জন্য এক বছরের প্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে সমগ্রই তার পছন্দমতো বিলি-বণ্টন করে দিতেন।
গণিমতের মালামাল-সম্পদ দুই প্রকারের ছিল, স্থাবর ও অস্থাবর। স্থাবরের বণ্টন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। অস্থাবরের মধ্যে জমিন বা ভ‚মি উল্লেখযোগ্য। বনি নজিরের জমিন হুজুর (সা.) ‘ফায়’ হিসেবে লাভ করেছিলেন এবং এ জমিন তার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। তিনি তা কারো মধ্যে বিলি বণ্টন করতেন না।
বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী তিন প্রকারের জমিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মালিকানা ও অধিকারে ছিল হেবা, দান এবং সন্ধির মাধ্যমে অর্জিত। খাইবার জয় করায় ‘ফেদক’ বাসীদের কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত জমিন এবং ‘ওয়াদিউল কোরা’-এর জমিনের এক তৃতীয়াংশ এবং খাইবারের দুইটি দুর্গ সন্ধির মাধ্যমে হুজুর (সা.) এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এ অস্থাবর সম্পত্তি হুজুর (সা.)-কে অর্থশালী করেছিল।
হুজুর (সা.)-এর উক্তি: ‘কাদাল ফাকরু আন-ইয়াকুন কোফরান’ (অভাব কোফরকে ডেকে আনে)। অভাবের কারণে মানুষ কোফরি করতেও দ্বিধা করে না। অভাব মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তির ন্যায় গর্হিত কাজের দিকে ধাবিত করে। তাই হুজুর (সা.) ভিক্ষাবৃত্তির বদলে শ্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং এ সম্পর্কে তার বহু মূল্যবান উপদেশ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যারা ফকির-অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং কায়িক পরিশ্রম ও যে কোনো বৈধ পেশা অবলম্বন করে জীবনযাপন করে, এরূপ ফকির, অভাবী, দরিদ্র, মিসকিনদের জন্য হুজুর (সা.) গর্বের কথা বলেছেন, যা ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে হাজার গুণে উত্তম।
দোজাহানের শাহেনশাহের ওফাতের সময় তাঁর ‘মাতরুকাত’ বা রেখে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বা সম্পদরাজির এক দীর্ঘ তালিকা বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হুজুর (সা.)-এর বিখ্যাত উক্তি : ‘আমরা নবীগণের জামাত, আমাদের মাল-সম্পদের কোনো তর্কা নেই, তারা যা কিছু রেখে যান তা সাদকা, অর্থাৎ- আল্লাহর মাল।’ তিরমিজির বর্ণনা অনুযায়ী হুজুর (সা.) কালকের জন্য কিছু জমা করে রাখতেন না। মুসনাদে আহমদ অনুযায়ী, হজরত আয়েশা (রা.) জবানীতে, ‘যে কটি আশরাফি সংরক্ষিত ছিল ওফাতের পূর্বে সেগুলোও তিনি খয়রাত করে দেয়ার নির্দেশ দেন।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন