সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জলাবদ্ধতা নিরসনে রাজধানীর খালগুলো উদ্ধার করতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

কে বলবে এক সময় ঢাকা ছিল একটি প্রাকৃতিক শহর? চারপাশের চার নদী এবং সেই নদীর শাখা-প্রশাখা এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এক অপূর্ব শহরে পরিণত করেছিল? জালের মতো বিস্তৃত স্বচ্ছ বারিধারার খাল ও লেকের কারণে এক অনিন্দ্য সুন্দর শহর হয়ে ছিল? এ সময়ের ঢাকার চিত্র দেখলে এ দৃশ্য কেবল কল্পনার মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে। ইট-পাথরের এক কংক্রিটের নগরী ছাড়া প্রাকৃতিক কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ঢাকা পরিণত হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ অবাসযোগ্য নগরীতে। অথচ বিশ্বে ঢাকার মতো চারপাশে নদ-নদী ও অভ্যন্তরে বিস্তৃত প্রবাহমান খাল ও জলাশয় সমৃদ্ধ নগরী আর একটিও নেই। প্রকৃতির অপার দান এই ঢাকা এখন পরিণত হয়েছে অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ, অবৈধ দখল ও দূষণের নগীরতে। যানজট আর দূষিত নগরীর শীর্ষে। বর্ষার বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতায় ডুবে যায় হাঁটু থেকে বুক সমান পর্যন্ত। সড়কগুলো যেন পরিণত হয় হারিয়ে যাওয়া খালে। মাটির নিচ থেকে খালগুলো ভেসে উঠে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে এক সময় ৫৪টি খাল ছিল। তবে জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ছিল ৭৭টির বেশি। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, রাজধানীর বুক চিরে কত স্বচ্ছ বারিধারা বয়ে যেত। এখন এসব খালের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকারি-বেসরকারিভাবে দখল হয়ে খালগুলো হারিয়ে গেছে। খালের উপর গড়ে উঠেছে বড় বড় ইমারত ও সড়ক। বর্তমানে ২৬টি খালের কথা বলা হলেও সেগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বেশিরভাগই ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ফলে বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে ভয়াবহ পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যুগের পর যুগ ধরে এ পরিস্থিতি চলে আসছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর সিংহভাগ এলাকায় পর্যাপ্ত ড্রেনেজ সিস্টেম নেই। এ দায়িত্ব ওয়াসার হলেও সংস্থাটি ড্রেনেজ সিস্টেম করতে ব্যর্থ হয়েছে। পানিবদ্ধতার কারণে অসহনীয় জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হলে ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ শুরু হয়। ওয়াসা বলে পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলে এ দায়িত্ব ওয়াসার। এই পারস্পরিক দোষারোপের কারণে পানিবদ্ধতার নিরসন হয় না। শুষ্ক মৌসুম এলে এ দোষারোপ বন্ধ থাকে। তবে আশার কথা, রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে এবার একক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। গত ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে পানিবদ্ধতার একক দায়িত্ব দেয়া হয় সিটি করপোরেশনকে। চুক্তি অনুযায়ী, রাজধানীর ২৬টি খাল ও ৩৮৫ কিলোমিটার মূল ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব পেয়েই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেছেন, রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে তিনি বদ্ধপরিকর। প্রতিটি বক্স কালভার্টের বর্জ্য অপসারণ করার পাশাপাশি খাল পরিস্কারের কাজ শুরু করবে। পাশাপাশি খাল দখলকারিদের ছাড় দেয়া হবে না। উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীর বিদ্যমান খাল সংরক্ষণে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। দায়িত্ব নেয়ার তিন দিনের মাথায় গত ২ জানুয়ারি থেকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কাজ শুরু করে দিয়েছে। লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে জুনের মধ্যে খাল ও বক্স কালর্ভাট এবং প্রধান প্রধান ড্রেন পরিস্কারের কাজ সম্পন্ন করবে। কথা অনুযায়ী, কাজের প্রথম দিন ডিএসসিসি’র পান্থকুঞ্জ এলাকার পান্থপথ বক্স কালভার্টের পাঁচটি ড্রেনেজ পিট থেকে ৭৪ টন বর্জ্য অপসারণ করেছে। এই কালভার্টের ২৪টি পিট রয়েছে। ভাবা যায়, একটি এলাকার বক্স কালভার্টের এক অংশেই এই বিপুল বর্জ্য জমে ছিল? পুরো কালভার্ট পরিস্কার করলে কত শত টন বর্জ্য অপসারিত হবে, তা এই হিসাব থেকেই বোঝা যায়। বছরের পর বছর ধরে এই বর্জ্য জমে আছে। জমতে জমতে তা কঠিন আকার ধারণ করেছে। পরিস্কারের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। এক কালভার্ট থেকে এই বিপুল বর্জ্য অপসারণ করা যে সহজ কাজ নয়, তা বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। এরপর বর্জ্য অপসারণ করা হবে সেগুন বাগিচা বক্স কালভার্টের। পুরো রাজধানীর খাল ও বক্স কালভার্টের বর্জ্য অপসারণ করা হলে কি পরিমাণ বর্জ্য হবে তা ভাবা যায় না। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বক্স কালভার্টের বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি জিরানী, মান্ডা ও শ্যামপুরের খালের বর্জ্য অপসারণের কাজ শুরু করেছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুটি বক্স কালভার্ট ও তিনটি খালের বর্জ্য অপসারনের কাজ মার্চ মাসের মধ্যে শেষ করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছে। বর্জ্য অপসারনের সঙ্গে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করে সীমানা নির্ধারণ করা হবে। আমরা মনে করি, প্রাথমিকভাবে দুটি বক্স কালভার্ট ও তিনটি খালের বর্জ্য অপসারণ করা গেলে পানিবদ্ধতার দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে।

সিটি করপোরেশন প্রাথমিকভাবে খাল ও বক্সকালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারনের যে কাজ শুরু করেছে, তা পুরো রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেমের তুলনায় যৎসামান্য হলেও কাজটি যে শুরু হয়েছে, এটা অবশ্যই ইতিবাচক। কারণ, যুগের পর যুগ পানিবদ্ধতার জনদুর্ভোগ নিয়ে কথা হলেও এতটুকু কাজও করা হয়নি। কেবল পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল, কোনো উদ্যোগ ছিল না। বছর চারেক আগে ভারি বর্ষণে ঢাকা ডুবে যে ভয়াবহ পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ে সে সময়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওয়াদা করে বলেছিলেন, আগামী বছর এই পানিবদ্ধতা থাকবে না। দেখা গেছে, তিনি তার সেই ওয়াদা রক্ষা করতে পারেননি। পরের বছরই ভয়াবহ পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং তা অব্যাহত থাকে। এ নিয়ে তিনি সমালোচনারও শিকার হয়েছিলেন। বর্তমান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের উদ্যোগে পানিবদ্ধতা নিরসনের একক দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দেয়া হয়েছে। এটি অত্যন্ত ভাল একটি উদ্যোগ। এতে এখন আর সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা কেউ কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, সিটি করপোরেশন তার দায়িত্ব কতটা পালন করে। যদিও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই যে কাজ শুরু করেছে, তাতে নগরবাসী কিছুটা হলেও আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তার কথা মতো যদি জুনের মধ্যে খাল ও বক্স কালভার্টের বর্জ্য অপসারণ করা যায়, তা হলে রাজধানীর পানিবদ্ধতা অনেকটাই কমে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা ও উদ্যোগ নিলে তা সম্পন্ন করা সম্ভব। এক সময়ের মজা ও বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হওয়া হাতিরঝিল আজকের নান্দনিক রূপ লাভ করেছে শুধু দৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য। সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার পর তারা এর কাজ যেমন দ্রæত ও নান্দনিকভাবে সম্পন্ন করেছে, তেমনি তারা প্রশংসিতও হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে তাদের সুপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের কারণে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওপর পানিবদ্ধতা নিরসনের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা যদি দৃঢ়তার সাথে বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে এই সমস্যার সমাধানও দ্রæত করা সম্ভব।

আমরা মনে করি, রাজধানীর প্রধানতম সমস্যার একটি পানিবদ্ধতা নিরসনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করবে। এ ব্যাপারে দুই মেয়রের আন্তরিকতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দৃঢ়তাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজধানীকে পরিচ্ছন করে তোলা এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে তাদের পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। খাল ও বক্স কালভার্টের বর্জ্য অপসারনের প্রাথমিক যে কাজ শুরু হয়েছে, তা সবসময়ের জন্য বলবৎ রাখতে হবে। তাদের এই উদ্যোগ যাতে লোক দেখানোতে পরিণত না হয়, এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। আমরা দেখেছি, ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদের পর তা পুনরায় দখল হয়ে যায়। উদ্ধারকৃত জায়গা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিষয়টি অনেকটা উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলায় পরিণত হয়েছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদের মতো বর্জ্য অপসারণের বিষয়টি যাতে লোক দেখানো না হয়, এ ব্যাপারে দুই সিটি করপোরেশনকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। রাজধানীর অভ্যন্তরে যেসব খাল রয়েছে এবং যেগুলো অবৈধ দখলে হারিয়ে গেছে, সেগুলো উদ্ধারে সিটি করপোরেশনকে কঠোর হতে হবে। অবৈধ দখলকারি যত প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের কবল থেকে খালগুলো উদ্ধারে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না। বিদ্যমান এবং অবৈধ দখলে থাকা খালগুলো উদ্ধার করে সেগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে সচল করতে হবে। খাল ও বক্স কালভার্টে জমে থাকা বর্জ্য অপসারণ করে থেমে থাকলে চলবে না, সেগুলো নিয়মিত পরিস্কারের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। নগরবাসীও যাতে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলে এ ব্যাপারে তাদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি তাদের সচেতন করার জন্য দুই সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন