কাফের-মোশরেকদের অভ্যাস ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হেয়প্রতিপন্ন করার সকল উপায় অবলম্বন করা। এ জন্য তারা নির্লজ্জভাবে তাঁর শানে এমন কথাবার্তা মন্তব্য করত, যা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন লোক করতে পারে না। তাদের এ ধরনের অবান্তর, অশালীন ও বেহুদা প্রশ্ন-অভিযোগের বিষয়গুলোর উল্লেখ করে কোরআনে তাদের ‘জালেম’ ও ‘পথভ্রষ্ট’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাদের অন্যায় আরোপ ও অপবাদ সম্পর্কে সূরা ফোরকানে আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য আহার করে এবং হাটেবাজারে চলাফেরা করে? তাঁর কাছে কেন কোনো ফেরেশতা নাযিল করা হলো না যে, তাঁর সাথে সতর্ককারী হয়ে থাকত? অথবা তিনি ধনভান্ডার প্রাপ্ত হলেন না কেন, অথবা তাঁর একটি বাগান হলো না কেন, যা থেকে তিনি আহার করতেন? জালেমরা বলে, তোমরা তো একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তিরই অনুসরণ করছ। দেখুন তারা আপনার কেমন দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে। অতএব, তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে, এখন তারা পথ পেতে পারে না।’ (আয়াত: ৭-৯)
আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলা হয়: এরূপ করা আমার জন্য মোটেই কঠিন নয় যে, আমি আমার রাসূলকে বিরাট ধনভান্ডার দান করি এবং বৃহত্তম রাজ্যের অধিপতি করি, যেমন ইতিপূর্বে আমি হজরত দাউদ ও সোলায়মান (আ.)-কে অগাধ ধনদৌলত ও বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীন রাজত্ব দান করে এই শক্তি-সামর্থ্য প্রকাশও করেছি। কিন্তু সর্বসাধারণের উপযোগিতা ও অনেক রহস্যের ভিত্তিতে পয়গম্বর সম্প্রদায়কে বস্তুনিষ্ঠ ও পার্থিব ধনদৌলত থেকে পৃথকই রাখা হয়েছে। বিশেষ করে নবীকুল শিরোমনি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-কে আল্লাহতাআলা সাধারণ দরিদ্র মুসলমানের কাতারে এবং তাদের অনুরূপ অবস্থার মধ্যে রাখাই পছন্দ করেছেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)ও নিজের জন্যে এই অবস্থাই পছন্দ করেছেন। ‘মুসনাদে আহমদ’ ও ‘তিরমিযী’তে হজরত আবু উমামার জবানী রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার পালনকর্তা আমাকে বলেছেন, ‘আমি আপনার জন্যে সমগ্র মক্কা ভ‚মি ও তার পর্বতসমূহকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করে দেই।’ আমি আরয করলাম, ‘না, হে আমার পালনকর্তা! আমি একদিন পেট ভরে খেয়ে আপনার শোকর আদায় করব ও একদিন উপবাস করে সবর করব, এ অবস্থাই আমি পছন্দ করি।’ হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি ইচ্ছা করলে স্বর্ণের পাহাড় আমার সাথে ঘোরাফেরা করত।’ (মাযহারী)
আল্লাহতাআলা তাঁর নবী-রসূলগণকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পার্থিব সম্পদের অধিকারী করেননি, তাঁরা চাইলে তা করা আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। হজরত সোলায়মান ও হজরত দাউদ (আ.)-এর কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত মূসা (আ.) সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(তিনি বলেন) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন এবং তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর প্রাণ জীবিত করবেন এবং আশা করি, তিনিই কিয়ামতের দিনে আমার অপরাধ মার্জনা করে দেবেন।’ (সূরা: শুআরা, আয়াত: ৭৮-৮২)
হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর ন্যায় মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন আল্লাহতাআলার প্রতি নিবেদিত প্রাণ, আল্লাহর ধনভান্ডার তার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তিনি চাইলেই তা প্রাপ্ত হতেন, কিন্তু তিনি নিজের জন্য কখনোই তা চাননি, যা কিছু চেয়েছেন তা কেবল উম্মতের জন্য প্রার্থনা করেছেন।
বর্ণিত বিবরণের মর্মকথা এই যে, আল্লাহতাআলার রহস্যাবলী এবং সাধারণ মানুষের যোগ্যতা উপযোগিতার ভিত্তিতেই নবী-রসূলগণ সাধারণত; প্রচলিত অর্থে দরিদ্র ও উপবাস থাকতেন, কিন্তু আল্লাহতাআলার পক্ষ হতে তাদেরকে আহার্য দান করা হতো, যার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাছাড়া তাদেরকে আল্লাহতাআলা এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, ধনদৌলতের প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ-আগ্রহ বা ঔৎসুক্যই ছিল না, বরং তাঁরা দারিদ্র্য ও উপবাসকেই পছন্দ করেছেন।
বর্ণিত আয়াতে কাফের-মোশরেকদের দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি পয়গম্বর হলে সাধারণ মানুষের মতই পানাহার করতেন না এবং জীবিকা উপার্জনের জন্যে হাটেবাজারে চলাফেরা করতেন না। এ মূর্খদের জবাব আয়াতেই দেয়া হয়েছে। যে সব পয়গম্বরকে তোমরাও নবী ও রসূল বলে স্বীকার করো, তারাও তো মানুষই ছিলেন, তারা মানুষের মতো পানাহার করতেন এবং হাটেবাজারে চলাফেরা করতেন। এ থেকে তোমাদের বুঝে নেয়া উচিত ছিল যে, পানাহার করা ও হাটবাজারে চলাফেরা করা নবুওয়াত ও রেসালতের পরিপন্থি নয়, বরং আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য লোক সমাগমে গমন করার বিশেষ গুরুত্বও রয়েছে।
দুনিয়ার প্রায় সকল রাজা, বাদশাহ, সম্রাটের সাথে ‘দোজাহানের শাহেনশাহ’-এর তুলনা করা ধৃষ্টতার শামিল। দুনিয়ার দুর্বল শ্রেণিগুলো যারা ছিল অবহেলিত, উপেক্ষিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, ‘দোজাহানের শাহেনশাহ’-এর নিকট তারাই ছিল অধিক প্রিয়। সকল শ্রেণির এ বঞ্চিত, অবহেলিতদের সকল অধিকার তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। কেউ অভাবী থেকে যেন কুফরি কাজে লিপ্ত না হতে পারে, একান্ত সে জন্য সক্ষম ব্যক্তিদেরকে সৎকর্মের উপদেশ ও ভিক্ষাবৃত্তি নিষেধ করেছেন। অপরদিকে অভাবীদের অভিভাবক হিসেবে তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তাই তিনি বলেছেন: ‘আল ফাকরু ফাখরি’, অর্থাৎ ‘অভাব আমার গর্ব।’ (সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন