বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও কোন চাকরি জোটেনি হাসানের (ছদ্মনাম)। অভিজ্ঞতা না থাকায় ধার দেনা করে মাছ চাষ শুরু করে লোকসানে পড়েন। বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেও হয়েছেন প্রতারিত। বড় ছেলে হয়েও পরিবারের জন্য কিছু করতে না পারার হতাশা থেকে প্রথমে গাঁজায় টান। এরপর ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। হাল ধরার বদলে তিনি এখন পরিবারের বোঝা। তার চিকিৎসা চলছে নগরীর হালিশহরের একটি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে তার মতো হতাশা থেকে অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। নেশায় জড়ানোর অনেক কারণ থাকলেও তার অন্যতম হতাশা। বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়েও অনেকে বিপদগামী হচ্ছেন। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংসের পথে নতুন প্রজন্ম। মাদকাসক্তিতে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। পরিবার সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে, ভাঙ্গছে সংসার। স্বজনের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে মাদকাসক্তের হাত।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সুশাসনের ঘাটতি থেকে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হচ্ছে। মেধার যথাযথ মূল্যায়ন না থাকায় বেকারত্ব সেইসাথে হতাশা বাড়ছে। পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে যুবকরা বিপথগামী হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ছাড়া উন্নত দেশের স্বপ্ন অর্থহীন হয়ে যাবে। নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, আসক্তির সাথে অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে।
সম্প্রতি নগরীতে বেশ কয়েকজন নারী ছিনতাইকারী গ্রেফতার হন, তাদের বেশিরভাগই নেশাগ্রস্ত। বস্তি থেকে অট্টালিকা সর্বত্রই মাদকের ছোবল। পুলিশ, চিকিৎসক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীরাও আসক্ত হয়েছেন। লোভে পড়ে শিক্ষার্থীরাও এই মাদক ব্যবসায় নেমে পড়েছে। সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে ইয়াবা পাচারকালে এক বিবিএ শিক্ষার্থীসহ দুই কলেজ ছাত্র ধরা পড়েন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে আসক্তদের কোন পরিসংখ্যান নেই। কারা কিভাবে মাদকাসক্ত হচ্ছেন এরকম কোন জরিপও হয়নি। তবে নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা আসক্তদের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি চিত্র পাওয়া যায়। মহানগরীতে সরকারি-বেসরকারি ১৭টি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে প্রতিবছর সাত শতাধিক মাদকাসক্তের চিকিৎসা দেয়া হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, তাদের বিরাট অংশ হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হয়েছেন। চাকরি না পাওয়া কিংবা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারা এবং পারিবারিক কলহ-বিরোধে হতাশার কারণে তারা নেশার দিকে ঝুঁকছে। উল্লেখযোগ্য অংশ সঙ্গ দোষে নেশায় জড়িয়েছে।
নগরীর কয়েকটি নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে আসক্তদের সাথে কথা হয়। তারা জানালেন, বেকারত্ব এবং হতাশা থেকেই নেশার অন্ধকারে পা বাড়িয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি চাকরির জন্য টানা কয়েক বছর চেষ্টা করেছেন। বিসিএস পরীক্ষায় কয়েক দফায় ভাইভা পর্যন্ত দিয়েছেন, কিন্তু চাকরি জোটেনি। মা-বাবার সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে পড়ালেখা শেষে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারার হতাশা থেকেই তারা বিপথগামী হন। অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে নেশায় জড়ানোর কথা বললেন ২৮ বছরের এক যুবক। বাবা থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানে তার বিরাট ব্যবসা। ৮ম শ্রেণি থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে একাই ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। দুই হাতে টাকা উড়ান, সাথে নেশা। নেশার ছোবলে এখন কাহিল ধনাঢ্য পরিবারের এ একমাত্র সন্তান।
কসাই বাবার ছেলে বন্ধুদের পাল্লায় পরে গাঁজা টানা শুরু করেন। এরপর নেশার টাকা জোগাতে গোশতের দোকানে বসে ওজনে কম দেন। এক দিনমজুর জানালেন, সংসারের ঘানি টানতে রাতে-দিনে কাজ করতেন তিনি। এক বন্ধু বুদ্ধি দিলেন ‘গাঁজা টান, এতে শক্তি বাড়বে।’ বন্ধুর এ বুদ্ধিতেই তিনি এখন ইয়াবা আসক্ত। নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় সবার নেশার জগতে আসার গল্প একই রকম।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড নেই। গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় দুর্নীতি এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে। মেধার মূল্যায়ন না হওয়ায় তরুণরা হতাশাগ্রস্ত, বেকারত্ব বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগেও অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নৈতিক অবক্ষয়। মানবিক সমাজ ছাড়া উন্নয়ন কখনো টেকসই হবে না। সাধারণ মানুষ এ উন্নয়নের সুফল পাবে না। দেশ পরিচালনায় যারা আছেন তাদের ভেবে দেখা উচিত নতুন প্রজন্মের জন্য আমরা কেমন দেশ রেখে যাচ্ছি।
বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মাদকের ভয়াবহতা এবং আসক্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে না পারার দায় শুধু পরিবারের নয়। সরকার এবং রাষ্ট্রও এ দায় এড়াতে পারে না। সুশাসনের অভাব এবং বিচারহীনতায় বাড়ছে দুর্নীতি। শিক্ষিত যুবকদের সামনে আশার আলো নেই। মূল্যবোধের অবক্ষয় তাদের গ্রাস করছে। তাদের বাদ দিয়ে উন্নত দেশের স্বপ্ন সফল হবে না।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর মাওলানা গিয়াস উদ্দিন তালুকদার বলেন, ১৫শ’ বছর আগে ইসলাম মদ, জুয়াকে হারাম ঘোষণা করেছে। এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধি আরোপের মাধ্যমে শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। এখন বিশ্বব্যাপী মাদকের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়ে প্রকারান্তরে ইসলামের সে বিধানকেই মেনে নিচ্ছে। ইসলাম যা কিছু হারাম করেছে তা মানুষের কল্যাণেই করেছে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলনে সরকার আলেমদের সহযোগিতা নিতে পারে। জুমার খুৎবা এবং ওয়াজ মাহফিল শক্তিশালী মিডিয়ার ভূমিকা পালন করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন