মেহেদী হাসান পলাশ
গত ২৪ আগস্ট বুধবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গুলশানে নিজ দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পকে দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে বলেন, ভারত নিজের দেশে যা করতে পারেনি, কেবলমাত্র ব্যবসার স্বার্থে বাংলাদেশে তা করছে। ভারতের ‘ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন’ নামের যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যৌথভাবে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে সেই একই প্রতিষ্ঠান ভারতের মধ্য প্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। নরসিংহপুর প্রকল্পটি ১০০০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব ছিল। অথচ রামপালে এই একই আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য দেওয়া হয়েছে ১৮৩৪ একর জমি। নরসিংহপুরের প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে প্রধানত: ৩টি কারণে: ক) জনবসতিপূর্ণ এলাকায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, খ) কৃষিজমিতে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না এবং গ) নর্মদা নদী থেকে ঘণ্টায় ৩২ কিউসেক পানি নেওয়া যাবে না। নরসিংহপুরের সঙ্গে রামপালের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ক) নরসিংহপুর জেলার আয়তন ৫১২৫.৫৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৮৭ জন। অন্যদিকে বাগেরহাট জেলার আয়তন ৩৯৫৯.১১ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩৮২ জন। খ) নরসিংহপুরের জমি দ্বি-ফসলি, কিন্তু রামপালের জমি তিন ফসলি। গ) নর্মদা নদী থেকে ঘণ্টায় ৩২ কিউসেক পানি নেওয়া যাবে না বলে মধ্যপ্রদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অথচ নর্মদার চেয়েও ছোট পশুর নদী থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১৪৪ কিউসেক পানি নেওয়া হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, খালেদা জিয়া বলেন, ভারতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আইনি বাধা আছে। অথচ সে দেশেরই একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের নিজের দেশে যা করতে পারে না শুধুমাত্র ব্যবসার স্বার্থে বাংলাদেশে তা করছে। আর জনগণের প্রতি দায়িত্বহীন এবং দেশের স্বার্থের প্রতি উদাসীন বাংলাদেশ সরকার তার অনুমতি দিয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে ভারতের কর্নাটক রাজ্যের রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের ২০ কিলোমিটার দূরে ১ হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ভারত সরকার বাতিল করতে বাধ্য হয়। বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় ভারত সরকার তামিলনাড়ু রাজ্যের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব বাতিল করেছে ২০১২ সালে। অন্যদিকে ভারতের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের এক গবেষণায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্বপ্রাপ্ত ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনকে ভারতের সবচেয়ে দূষণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া আরো বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের জন্য একটি অলাভজনক প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতীয় কোম্পানী ১৫% বিনিয়োগ করে লাভের অর্ধেক অর্থ নিয়ে যাবে। এই প্রকল্পের ১৫% অর্থ জোগান দেবে বাংলাদেশ পিডিবি, ১৫% ভারতীয় কোম্পানী এনটিপিসি এবং বাকি ৭০% ব্যাংক ঋণ নেওয়া হবে। কোম্পানী বন্ধ হলে কিংবা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পুরো ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ পিডিবি কিনবে, আর যে নিট লাভ হবে তা ৫০% হারে পিডিবি ও এনটিপিসির মধ্যে ভাগ হবে। কিন্তু ১০০% পরিবেশ ধ্বংস হবে শুধুই বাংলাদেশের। ১৫% বিনিয়োগ করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ৫০% মুনাফা নেবে এবং ট্যাক্স ফ্রি সুবিধার আওতায় মুনাফার পুরো টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাবে। রামপাল থেকে বিদ্যুৎ কিনে পিডিবিকেও ভর্তুকি দিয়ে জনগণের কাছে বিক্রি করতে হবে বলে সংস্থাটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
বেগম খালেদা জিয়া দৃঢ়কণ্ঠে জানান, সুন্দবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন একটি দেশবিরোধী ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। জনমত উপেক্ষা করে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী এই সিদ্ধান্ত জনগণের উপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে এই স্বৈরাচারী সরকার। আমরা মনে করি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জায়গারও অনেক বিকল্পও আছে। কিন্তু সুন্দরবনে কোনো বিকল্প নেই। কাজেই সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার হঠকারী, অযৌক্তিক, অলাভজনক রামপালের সকল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি পরিবেশ কিম্বা রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু দেশের অধিকাংশ পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশ কর্মী, সচেতন সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবী মহল রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে যুক্তি ও তথ্যসহ যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাতে সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু পরিবেশের জন্যেই ক্ষতিকর নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। কেননা একই দিন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জন্য ভারতের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংক থেকে ১৬০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০ শতাংশ করে মালিকানা দুই দেশের হলেও ঋণের পুরোটা দায়ভার থাকবে বাংলাদেশের ওপর। ব্যাংকিংয়ের ভাষায় বাংলাদেশ সরকার দেবে এ ঋণের ‘গ্যারান্টি’ অর্থাৎ জামিনদার হবে। এর মানে হলো, লোকসান হলে বা কোনো কারণে মাঝপথে প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা কিস্তির অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর বর্তাবে। বাংলাদেশকে এ ঋণের জামিনদার হওয়ার শর্ত দিয়েছে এক্সিম ব্যাংক।
এ সকল বিচারে এ কথা নির্দিধায় বলা যায়, রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের পরিবেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। দেশের অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে থাকে। আশা করি, সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেবে এবং এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী যেসব বিষয় আছে সেগুলোর ত্রুটি সংশোধন করবে। ঠিক যেভাবে জন প্রত্যাশাকে বিবেচনায় নিয়ে ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলেন। সাম্প্রতিককালে বিএনপির রাজনীতিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও তো অবশ্যই। সুন্দরবন রক্ষার জন্য যারা আন্দোলন করছেন তাদের ধন্যবাদ এ জন্য যে, তারা তাদের আন্দোলনে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি রাজনৈতিক জোটকে আন্দোলনে শরীক করতে সক্ষম হয়েছেন।
সরকারী জলুম-নির্যাতনে নিষ্পেষিত এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে শুরু করে একের পর এক সরকারী ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং জনসম্পৃক্ত বিষয়গুলো নিয়ে জোরালো কোনো অবস্থান নিতে পারেনি। ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া বিএনপিকে সরকার সমর্থক গণমাধ্যমে নানা টিটকারি, ঠাট্টা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছিল। ‘বিএনপি নাই’, ‘বিএনপিকে দিয়ে হবে না’, ‘বিএনপি শেষ’ ইত্যাদি মন্তব্য করে গণমাধ্যমে খবর পরিবেশনা, কথা বলা চালিয়ে দেশবাসীর মনে এক ধরনের প্রতীতি জন্মানোর চেষ্টা চলেছে, বিএনপি দায়িত্বশীল ও প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতির অনুপোযুক্ত হয়ে পড়েছে। রোজার পরে, ঈদের পরে, শীতের পরে, গ্রীষ্মের পরে অমুকের পরে, তমুকের পরে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নিজেই অনেকাংশে নিজেকে হাস্যষ্পদ করে তুলেছিল। তার উপর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়েও বিএনপি জাতীয় ইস্যুতে কোনো অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি। দলগুছিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে একাধিকবার দল গোছানোর কর্মসূচীতে হাত দিলেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত দল গুছিয়ে উঠতে পারেনি। শেষে ২০১৬ সালের শুরুতে কাউন্সিলের ঘোষণা আসে। গত ১৯ মার্চ বিএনপির ৬ষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের প্রায় ৬ মাস পর বিশাল কমিটি করেও বিএনপি আন্দোলন বিমুখ নেতাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
ঠিক সেই মুহূর্তে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে এক পত্র দিয়ে জানান, ‘ভারত সুকৌশলে শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে, ভারতের জাতীয় স্বার্থে এবং ভারতকে অখ- রাখার অব্যাহত প্রচেষ্টায়। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার কৃতজ্ঞতায় আওয়ামী লীগ সরকার বন্ধুত্বের নামে নতজানু নীতি মেনে নিয়েছে। মাঝে মধ্যে আপনিও ভারতের সন্তুষ্টি অর্জনে চেষ্টা করছেন যা দেশবাসীর চোখে সুবিধাবাদী রাজনীতি বলে মনে হয়েছে। এ সরকারের বদান্যতায় প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স যাচ্ছে, প্রতি সপ্তাহে সীমান্তে একজন বাংলাদেশী মারা যাচ্ছে বিএসএফের হাতে, রামপালের উল্টো দিকে পশ্চিম বাংলার সুন্দরবন এলাকা রাঙ্গাবালিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র না করে মাত্র ১৫% মূলধন দিয়ে ভারত আমাদের দেশের রামপালে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করতে উদ্যত। আপনি এ সম্পর্কে মৃদু প্রতিবাদ করেছেন, আপনার দলকে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যোগ দিতে নির্দেশ দেননি....।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রামপাল ইস্যু নিয়ে খালেদা জিয়াকে কথা বলার আহ্বান জানান। রাজনৈতিক সচেতন মহলের অভিমত হচ্ছে, রামপাল আন্দোলনের শুরু থেকেই বেগম খালেদা জিয়া অপ্রকাশ্যে এই আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। একই সাথে খালেদা জিয়ার এই অবস্থানকেও তারা বিএনপির রাজনীতিতে ফেরার আভাস বলে ধারণা করছেন। গণতন্ত্র, নির্যাতন, দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, মামলার সরকারী রাজনীতির ঘোরপাঁকে বন্দী বিএনপি দীর্ঘদিন পর জাতীয় স্বার্থ ও গণসম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। রাজনীতির এটি ইতিবাচক মোড় বলেই সকলের অভিমত। দেখা যাক, বিএনপি এ পথে কতদূর যেতে পারে। তবে বিএনপি রামপাল ইস্যু নিয়ে কথা বলার ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা শুরু হলো- ভারতবিরোধী রাজনীতিতে ফিরছে বিএনপি। বিএনপির প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এই বৈরী নীতি দৃষ্টিকটুভাবে শুরু থেকেই চলে আসছে। রামপাল ইস্যু নিয়ে সুলতানা কামাল, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আনু মুহম্মদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আবুল মকসুদ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। তাদের বিবেচনায় সেটা ছিল ‘প্রগতিশীল’ ও ‘সুশীল সমাজের গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ সুন্দরবন ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনে বিএনপি যখন সমর্থন জানাচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে ‘ভারতবিরোধী’ আন্দোলন।
ভারত বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী। প্রায় তিনদিক দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে বেষ্টন করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে বেশী সহায়তা দিয়েছে না গত ৪৬ বছরে বাংলাদেশ ভারতকে বেশী দিয়েছে সেই পুরাতন কাসুন্দি না ঘাটলেও এ কথা নির্দিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত ভারতবিরোধী নয়। এ কথা সত্য যে, এদেশে যেমন স্বল্পসংখ্যক ভারতপ্রেমী রয়েছে, তেমনি কিছু ভারতবিরোধী লোকও থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ভারতবিরোধী নয়। বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখে একসাথে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, ইতিহাস ও সংগ্রামে বাংলাদেশ ও ভারতের রয়েছে একসাথে দীর্ঘ পথ চলার ইতিহাস। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন আধিপত্যবাদী ও বাংলাদেশবিরোধী কাজের বিরোধিতা, প্রতিবাদ তারা করেছে কিন্তু তা কখনোই ভারতবিরোধী নীতি ছিল না। ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী নীতি ও কাজ সমর্থন না করা ও তার প্রতিবাদকে এদেশের ভারতপ্রেমী জনগোষ্ঠী ভারত বিরোধী বলে ব্রান্ডিং করেছে। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশীদের ‘গরু চোর’ বলতে না পারা ভারত বিরোধিতা নয়। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের প্রয়োজনের সময় পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারা ও অপ্রয়োজনীয় সময়ে বিপুল পানি ছেড়ে ডুবিয়ে মারার প্রতিবাদ করা ভারত বিরোধিতা নয়। কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলন্ত ফেলানীর লাশের প্রতিবাদ করাও ভারত বিরোধিতা নয়। জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কথা বলা ও কাজ করা ভারত বিরোধিতা নয়।
বিএনপির জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই দলটি কখনোই ভারতবিরোধী ছিল না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ভারতবিরোধী ছিলেন না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য হয়েও মুক্তিযুদ্ধে ভারতে গিয়ে ভারতীয় সহযোগিতা নিতে তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তিনি ভারত সফর করেন ও ভারতের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা চালান। প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি সার্কের ধারণা জনপ্রিয় করেন। ভারতপ্রেমীরা ফারাক্কা, টিপাইমুখে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না বলে তখন যেমন সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, এখনো তেমনি বলছেন ফারাক্কার বাঁধ ছেড়ে দিলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদশের মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। গ্রীষ্মে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারে, বর্ষায় ডুবিয়ে মারে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বাঁচা-মরার ফারাক্কা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে গিয়েছিলেন সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে, ভারত বিরোধিতা থেকে নয়। ভারতপ্রেমীরা এটাকে ভারতবিরোধী প্রচারণা দিয়ে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ভারতীয় মনোভাব পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলাফল অশোক রায়ানা তার ‘ইনসাইড র’ বইয়ে লিখেছেন। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পরও বিএনপি বিভিন্ন সময় ভারতের নানা বৈষম্যমূলক ও আধিপত্যবাদী নীতির বিরোধিতা করেছে। সেটাও ভারত বিরোধিতা ছিল না। সেটা ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদী ও বাংলাদেশ বিরোধী নীতির বিপরীতে বাংলাদেশের স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা। ভারতপ্রেমীরা এই চেষ্টাকে ভারতবিরোধী বলে বিএনপিকে ব্রান্ডিং করেছে। বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ দিল্লীতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষার বিএনপির প্রচেষ্টায় চেষ্টায় ছেদ ফেলতে চেয়েছে বটে, তবে সেটা যে বিএনপির মেইন স্ট্রিম রাজনীতি নয়, তার প্রমাণ রামপাল নিয়ে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অবস্থান। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার যখন বন্যার হাত থেকে নিজ রাজ্যের জনগণকে বাঁচাতে ফারাক্কা তুলে দেয়ার কথা বলেন, সেই একই কথা বাংলাদেশে কেউ বললে তাকে ভারতবিরোধী বলে অভিহিত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রের বিরোধিতা করে নিজ রাজ্যের স্বার্থে তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করেন, সেটাও ভারত বিরোধিতা নয়। কিন্তু তিস্তার সকল পানি বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে আটকে রাখার বিরুদ্ধে কথা বললে বাংলাদশে ভারত বিরোধিতা বলা হয়। ট্রানজিটের মাসুল চাইলে অসভ্যতা বলা হয়। এভাবে ভারতকে নিজেদের প্রতিপক্ষ থেকে সরিয়ে নিজেদের মিত্র হিসাবে পেতে এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের ভারতপ্রেমী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো জাতীয় স্বার্থের অনুকূল কথা ও কাজকে সফলভাবে ভারতবিরোধী ব্রান্ডিং করাতে পেরেছে। ভারতও প্রতিবেশীদের প্রতি অন্যায় আচরণগুলো নিজ দেশের মানুষের কাছে ঢাকতে এই ব্রান্ডিংয়ে মদদ দিয়েছে। ফলে দেশের মানুষের একটি অংশ ফারাক্কা, টিপাইমুখ, করিডোর, সীমান্ত খুন, চোরাচালান, তিস্তার পানি, অসম বাণিজ্য, রামপাল, টিভি চ্যানেল প্রভৃতি নিয়ে কথা বলতে দ্বিধান্বি^ত। দ্বিধান্বি^ত হলেও ভারতের এ সকল বৈরী নীতির ভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ হচ্ছে তারা ভেতরে ভেতরে। প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে, বিশেষ করে পিপল টু পিপল সম্পর্ক তৈরিতে এটা বড় বাধা। বাংলাদেশ ভারতকে করিডোর দিয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে করিডোর সুবিধা পাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিজ দেশের আকাশ ভারতীয় টিভি চ্যানেলের জন্য খুলে দিলেও ভারতের আকাশে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল প্রবেশ করতে পারছে না। এসব কথা বলা ভারত বিরোধিতা নয়। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো পছন্দ করে না। বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা ভারত বিরোধিতা নয়। ভারতকে এই সত্য অনুধাবন করতে হবে। প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে উদার ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিতে হবে। ভারত বাংলাদেশের সুপ্রতিবেশী হোক এটা সকলের প্রত্যাশা।
email: palash74@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন