খুলনা জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ডুমুরিয়া উপজেলার খর্নিয়া গ্রাম। ওই গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভদ্রা নদী। এক সময় খরস্রোতা এ নদী ফেরিতে করে পারাপার হতো মানুষ। সেখানে সেতু হওয়ার পর ফেরিঘাটের সংযোগ সড়কসহ নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠেছে সারি সারি ইটভাটা। শুরুতেই ইটভাটাগুলো নদীর চরের জমি দখলেই সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে নদীর মাঝ বরাবর পর্যন্ত দখলে নেওয়া হয়েছে। এতে স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়ে ভরাট হতে হতে এখন শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে খরস্রোতা ভদ্রা নদী।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, খর্নিয়া সেতুর গা ঘেঁষে প্রায় ২০ একর জমি দখলে নিয়ে গড়ে উঠেছে জাহান ব্রীকস ও শান ব্রীকস নামের দুটি বড় ইটভাটা। এই ভাটা দুটির জন্য নদীর এক তৃতীয়াংশ জমি দখল করা হয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, প্রতি বছর ইট ও বালুর বস্তা ফেলে নদীর জমি দখলে নিয়েছে ইটভাটার মালিক শাহাজান জমাদ্দার। তিনি ডুমুরিয়া উপজেলার প্রভাবশালী এক বিএনপি নেতার জামাতা। বিএনপি সরকারি ক্ষমতায় থাকাকালিন নদী তীর দখল করে এ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়। সে সময়ে স্থানীয় বাসিন্দারা আপত্তি তুললেও তা আমলে নেয়নি কেউ। তবে শাহাজান জমাদ্দার এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি নিজস্ব জমিতে ইটভাটা গড়ে তুলেছেন।
কেবল জাহান ব্রীকস নয়। খর্নিয়া গ্রামের ভদ্রা নদীর তীর দখলে নিয়ে ১৮টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। তারা প্রত্যেকেই খরস্রোতা ভদ্রা নদী হত্যার জন্য দায়ি। ইটভাটার পরিধি বাড়াতে একটু একটু করে নদীর মাঝ বরাবর দখল করে নিয়েছে তারা। কেবি ব্রীকস নামের ইটভাটাটি নদীর সীমানা নির্ধারণকারী পিলার থেকে আরও ভেতরে ইট-সুরকি ও বালু দিয়ে ভরাট করে দখলে নিয়েছে।
কেবি ব্রিকসের মালিক ও ডুমুরিয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বুলু দাবি করেছেন, বেশিরভাগ জমিই স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি করে নেওয়া হয়েছে। আর কিছু জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেখানে মাটি কেটে ফেলে রাখা হয়। খর্নিয়া গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, নদী দখলের পর ভাটা মালিকরা নদীতে বাঁধ দিয়ে ছোটো ছোটো পুকুর নির্মাণ করেছেন। এসব পুকুরে জমা পলিমাটি দিয়েই তারা ইট তৈরি করছেন।
তিনি বলেন, এভাবে বাঁধ দেওয়ায় নদীর স্রোত কমে যাচ্ছে। পলি পড়ে নদী নাব্যতা হারাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে গতিপথ। আবার কোথাও নদী প্রায় মরে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেতু ও বাজার। পানি নিষ্কাশনসহ নৌ-চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
তিনি আরও বলেন, নদীর পাড়ের এ জমি ভ‚মিহীন কৃষকরা সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছিলেন। সেইজমি ইটভাটার মালিকরা নানা কৌশলে দখলে নিয়ে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত জমি মিলিয়ে ২০০৯ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ১৮টি ভাটা গড়ে তুলেছেন।
এলাকার কৃষকরা জানান, ভাটার ধুলা আর কালি ফসলি জমিতে পড়ায় এলাকার কৃষি জমিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফসল উৎপাদনও কমে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইটভাটার জন্য কৃষি জমির মাটি আনা হচ্ছে বলেও তারা অভিযোগ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নদীর অববাহিকায় প্রায় ১৩ লাখ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে নদী খননসহ অবৈধ দখল নেওয়া নদী-খালে আড়াআড়ি বাঁধ ও নেট-পাটা উচ্ছেদের বিকল্প নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড পলি অপসারণের জন্য ২০০৮ সালে নদী ড্রেজিং শুরু করলেও প্রভাবশালীমহলের কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় আটলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান প্রতাপ রায় বলেন, ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত থেকে এক রায়ে নদীকে জীবন্ত স্বত্তা ঘোষণা করা হয়। যারা নদী হত্যার জন্য দায়ি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার বিধান থাকলেও ইটভাটা মালিকরা স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান হওয়ায় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, ইটভাটা থেকে যে দূষিত গ্যাস ও তাপ নির্গত হয় তা আশপাশের জীবজন্তু, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। ভাটার চিমনি দিয়ে বের হওয়া ধোঁয়ার তেজস্ক্রিয়তায় এলাকায় গাছের পাতা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ জমাদ্দার বলেন, ইটভাটা সরকারি জমির মধ্যে পড়লে সরকার নিয়ে নিলে আমাদের আপত্তি নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর অঞ্চলের (খুলনা, যশোর ও নড়াইল জেলা) প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, নদী দখল করে ইটভাটা স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক সাইফুর রহমান খান বলেন, পরিবেশ আইনের আওতায় যদি সঠিক থাকে, তাহলে সেই ইটভাটার অনুমোদন দিয়ে থাকি। তবে নদী দখল করে ভাটা থাকলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ বলেন, নদী সংস্কার সরকারের অগ্রাধিকারমূলক বিবেচনায় রয়েছে। স¤প্রতি ওই ইটভাটাগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে লাল কাপড় দিয়ে খুঁটি গেড়ে দেওয়া হয়েছে। খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, যারা নদী দখল করছে বা অবৈধভাবে ভাটা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওই এলাকায় জরিমানা আদায়ের সঙ্গে কয়েকটি লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন