দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সংঘটিত হত্যাকান্ডের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও সমস্যার বাস্তব সমাধানে কাজ করার কথা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে হত্যাকান্ড ভারতের মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা একমত হয়েছি যে প্রতিটি হত্যাকান্ডই দুঃখজনক। কিন্তু আমরা নিজেদের প্রশ্ন করেছি, সমস্যার মূল কারণ কি এবং এটি হচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকান্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা নিয়ে আমরা বর্তমানে কাজ করছি না। আমাদের (বাংলাদেশ ও ভারত) সম্পর্ক সত্যিকার অর্থে ৩৬০ ডিগ্রি। মানুষের সম্পর্কের সব ক্ষেত্রে আমরা কিছু না কিছু করছি। যতই কাজ করছি, ততই নতুন নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে।
দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি গুরুত্ব পায়নি। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির সময়সীমা নিয়ে এক প্রশ্নের কৌশলী জবাব দেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। খুব শিগগিরই আমাদের সচিবদের বৈঠক রয়েছে। আমি নিশ্চিত, তারা এ বিষয়ে পরবর্তী আলোচনা চালিয়ে নেবেন। আমি মনে করি, আপনারা এক্ষেত্রে ভারত সরকারের অবস্থান জানেন, যা এখনো পরিবর্তন হয়নি।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, দুই দেশের মিলিত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ‘অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন’ সীমান্ত। আমি নিশ্চিত, আমরা যদি এটা করতে পারি, অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন সীমান্ত, তাহলে একসাথে এই সমস্যার সমাধান করতে পারব। তিনি বলেন, যেটাকে আমরা সীমান্ত হত্যা বলি, মূলত অনেকগুলো মৃত্যু হয় ভারতের বহু ভেতরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী (এ কে আবদুল মোমেন) এবং আমি এ ব্যাপারে আলোচনা করেছি, যেভাবে প্রতিবেশী ও বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে যৌথসংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ৫০ বছরের সম্পর্ক। এ দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় যোগাযোগকে বড় পরিসরে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কানেক্টিভিটির এই জায়গাকে আমরা বড় লক্ষ্য হিসেবে ধরে এগোতে পারি। ভারত ও বাংলাদেশ যদি কানেক্টিভিটির জায়গায় ঠিকমতো কাজ করতে পারে, তাহলে পুরো অঞ্চলই বদলে যাবে। বঙ্গোপসাগরীয় এলাকাকে তখন অন্যরকম মনে হবে। তিনি আরো আমরা উভয়দেশ মনে করি এটা সম্ভব। আজকের দিনে আমাদের আলোচনার বড় অংশজুড়ে ছিল এটা। আমরা চাইলে এক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো দেশকেও একীভ‚ত করতে পারি। যেমনÑ জাপান, যাদের সঙ্গে আমাদের উভয়দেশের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় জাপান অনেক কানেক্টিভিটি প্রকল্পে যুক্ত।
এর আগে লিখিত বক্তব্যে ঢাকায় সফরতর ভারতের পররাষ্ট্র বলেন, আমাদের সম্পর্ক গৎবাঁধা অংশীদারিত্বের ঊর্ধ্বে। আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের বন্ধন শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে উভয় পক্ষই এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বিশেষত ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে।
বাংলাদেশের সঙ্গে এই সম্পর্ক ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির প্রাসঙ্গিকতার মধ্যেই নিহিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। জয়শঙ্কর বলেন, আমরা বাংলাদেশকে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও একটি মূল প্রতিবেশী এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের প্রতিটি অর্জন সমগ্র অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। সবাই জানেন যে, আমরা অন্যদের কাছে এই সম্পর্ককে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করি। এ কারণেই নিরাপত্তা, বাণিজ্য, পরিবহন ও সংযোগ, সংস্কৃতি, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক থেকে শুরু করে জ্বালানি ও অভিন্ন সম্পদ এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কের যৌথ বিকাশসহ সব ধরনের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব সম্প্রসারণে কাজ চলছে।
দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক কার্যক্রমগুলো ‘সাধারণ পরামর্শ এবং প্রস্তাবের ঊর্ধ্বে’ মন্তব্য করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, এসব কাজে মাঠ পর্যায়েও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে। এর সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণ হলো- চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আগরতলায় পরীক্ষামূলকভাবে পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা, ত্রিপুরাকে আপনাদের জাতীয় নৌপথে সংযুক্ত করার জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপথে দুটি নতুন প্রোটোকল রুট যুক্ত করা, ১০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ হস্তান্তর, কন্টেইনার ও পার্সেল ট্রেন চলাচল শুরু এবং জ্বালানি খাতে একটি যৌথ উদ্যোগ গঠন।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, প্রত্যেকের অগ্রাধিকারকে পরস্পরের জন্য কীভাবে লাভজনক করা যায়, তার ওপর ভিত্তি করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, এই মাসের শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর আমাদের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আমরা আনন্দিত, তিনি মোদি) মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং ভারতের সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনে অংশ নেবেন।
ঢাকায় শিগগিরই বঙ্গবন্ধু ও মহাত্মা গান্ধীর ওপর ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হবে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। করোনাভাইরাসের টিকাদানের ক্ষেত্রে দুই দেশের সমন্বিত উদ্বেগকে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর চ‚ড়ান্ত করতে ঢাকায় আসেন জয়শঙ্কর। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। অতঃপর বিকেলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাতেই তিনি দিল্লি ফিরে গেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন