তিস্তার পানি জটিলতা কাটছে না। বাংলাদেশ ও ভারত ২০১১ সালে দু’দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি নেয়া হলেও তা ১০ বছরে বাস্তবায়ন হয়নি। তিস্তার পানি বন্টনের ক্ষেত্রে একটি চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছিল।
ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম শহরে পানির সঙ্কট মোকাবিলায় ১.৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের ব্যাপারে ২০১৯ সালে সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু তিস্তার বিষয়ে পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে তা এগুতে পারেনি। অনেক চিঠি দেওয়ার পর ভারত থেকে সাড়া পায়নি বাংলাদেশ। সে কারণে এবার সময়ের আগে বাংলাদেশ থেকে তিস্তার পানি নিয়ে এ মাসে চিঠি দিবে যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশ। তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। বর্ষা শেষ না হতেই তিস্তার বুকজুড়ে জেগে উঠেছে বড় বড় আকা-বাকা চর। প্রমত্তা তিস্তা হেঁটেই পারাপাড় হচ্ছে লাখো মানুষ। আশ্বিনের শেষ, কার্তিকের শুরু। আর এতেই খরস্রোতা তিস্তা তার যৌবন হারিয়ে মরা তিস্তায় পরিণত হয়েছে। পানিসহ তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে ন্যূনতম পানির প্রয়োজন প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার কিউসেক। অথচ বর্ষা শেষ না হতেই গত ১০ দিনের গড়ে ব্যারেজের মূল গেটের পানি প্রবাহ রয়েছে ৬৫ হাজার ৮শ কিউসেক। যা দিয়ে তিস্তা ব্যারেজের প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করা কঠিন হবে।
এদিকে বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই দেশের পানি বণ্টনের মীমাংসা শুধু দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়, এক্ষেত্রে ভারতের রাজ্য সরকারের স্বার্থ এবং সম্মতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিরও এখানে প্রভাব রয়েছে। এখন ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের সবচেয়ে ভাল সসময় অতিবাহিত করছে বলেই দুই দেশ দাবি করে থাকে। কিন্তু নানামুখী চেষ্টার পরেও তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশে চরম হতাশা আছে বলে মনে করছেন পানি বিশেষজ্ঞরা।
গত ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের দ্রুত সমাধান চায়। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, নরেন্দ্র মোদির কাছে তিস্তা নিয়ে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, বহু বছর আগে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো গেলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তিস্তার বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের অন্য রকম আকাক্সক্ষা রয়েছে। এর পরে সচিব পর্যায়ের একটি যৌথ মিটিং হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মো. মাহমুদুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসর পর থেকে তিস্তার পানির বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন। যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশ থেকে কয়েকবার সভা হয়েছে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে তেমন সাড়ামেলেনি। সে কারণে আবারো তিস্তার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতেকে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানা গেছে, গত ১০ দিনে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে পানি প্রবাহ গড়ে রয়েছে ৬৫ হাজার কিউসেক। যেখানে এই সময়ে পানি থাকার কথা ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার কিউসেক। প্রতিদিনই কমছে পানি। ধীরে ধীরে পানি শূন্য হয়ে মরে যাওয়া এই তিস্তার সঙ্গে মরছে তিস্তাপাড়ের কৃষক ও জেলেরা। ভারতের গজলডোবা নামক স্থানে প্রবেশ মুখে ও লালমনিরহাটের দোয়ানিতে ব্যারেজ নির্মাণ করে এ নদীর দুর্বার গতিকে সভ্য সমাজের মানুষরা রোধ করে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে তিস্তার স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে তার বুক থেকে তুলে নেয়া হয়েছে পানি নামের জীবন। মরে গেছে তিস্তা। এই নদীর পারে দাঁড়ালে এখন বাতাসে শুনতে পাওয়া যায় ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস আর গুমড়ে ওঠা কান্নার শব্দ। দীর্ঘ এ তিস্তার বুকজুড়ে শুধুই ধু-ধু বালুচর। ৪১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ খরস্রোতা তিস্তা নদী সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট, রংপুর হয়ে কুড়িগ্রামের রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী এবং গাইবান্ধার ভেতর দিয়ে ১৬৫ কিলোমিটার অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে। ১৯৭৭ সালে তিস্তা নদীর ওপর ব্যারাজ, হেড রেগুলেটর ও ক্লোজার ড্যাম তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। এ বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজরে গেলে জলপাইগুড়ির গজলডোবায় (বাংলাদেশ থেকে ৭৫ কিলোমিটার উজানে) তারা ৯২১.৫৩ মিটার দীর্ঘ ব্যারাজ নির্মাণ করে। এই ব্যারাজটির মাধ্যমে ভারত তিস্তার মোট পানি পবাহের ৮০ শতাংশ নিয়ে তাদের কৃষি জমিতে সেচ দিচ্ছে।
গঙ্গা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কায় পানি ভাগা-ভাগি করে ভারত ও বাংলাদেশ। ২০১১ সালে দু’দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি নেয়া হলেও ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা সম্পন্ন করা যায়নি। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি অমীমাংসিত ইস্যু। দু’দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানির বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। গঙ্গা চুক্তির পর আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারটি। ২০১১ সালে দু’দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি নেয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা সম্পন্ন করা যায়নি। বাংলাদেশ এবং ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদী বা অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি কমিটি তিন বছর পর গত ৫ই জানুয়ারি থেকে দুই দিন বৈঠক হয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বৈঠকটি হয়েছে ভার্চুয়ালি। বৈঠকে অভিন্ন ৬টি নদীর পানি বণ্টনে একটি কাঠামো চুক্তি কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এই নদীগুলো হচ্ছে, মনু ও মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কুশিয়ারা নদীতে একটি সেচ প্রকল্পের জন্য ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলনের জন্য খাল সংযোগের ব্যাপারে ভারতকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার তাগাদা দেয়া হয়। দুপক্ষই নিজ নিজ দেশের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছে। কিন্তু তিস্তার বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে সব সময়।
ডালিয়া পাউবোর একজন প্রকৌশলী ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তায় ২০ শতাংশ পানি ভারত ভাটিতে ছাড়লেও ৭৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই স্রোতধারা বাংলাদেশের দোয়ানীতে ব্যারাজ এলাকার পথে একেবারেই ক্ষীণ হয়ে যায়। ভারত যে সময়টাতে তাদের ব্যারাজের গেট বন্ধ করে দেয় তখন সর্বনিম্ন এক হাজার কিউসেক পানি সেচ খালে সরবরাহ নিলে আর ভাটিতে ছেড়ে দেয়ার উপায় থাকে না।
এ বিষয়ে নদী গবেষক ও রিভারাইন পিপলসের পরিচালক এবং রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডীন ড. তুহিন ওয়াদুদ ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তা নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন নদী। এখানে দখল-দূষণ তুলনামূলক কম। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে একতরফাভাবে ভারত পানি প্রত্যাহার করায় নদীটি দিন দিন মরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নদীর পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে যৌথ নদী কমিশনের একজন বিশেষজ্ঞ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস এর নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান বিবিসিকে বলেন, আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চুক্তির মাধ্যমেই একটি দেশের পানির হিস্যা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হয়। যৌথ নদী কমিশনের এবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বছেন, মূলত ছয়টি নদীর পানি বন্টন নিয়ে আলাপ হলেও তিস্তা এবং ফেনী নদীর প্রসঙ্গও চলে এসেছে। ছয়টি নদী ভারতের যে রাজ্যগুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেই রাজ্যগুলোর সরকারও যেন আলোচনা বা চুক্তির প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে, সেটা এখন বাংলাদেশ চাইছে। তিস্তার পানি বন্টনের ক্ষেত্রে একটি চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছিল। পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে তা এগুতে পারেনি। বাংলাদেশ তাই রাজ্যগুলোর অংশগ্রহণ চাইছে।
অপর দিকে দিল্লির বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত বিবিসিকে বলেন, দু’দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগির ইস্যুতে মীমাংসার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যেরও ঘাটতি আছে। আমাদের বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের অভাব আছে। পানির প্রবাহ এমনিতে বোঝা যায় না, তার একটা লম্বা সময়ের স্টাডি দরকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন