পবিত্র আত্মা বা রূহে ইনসানী এবং স্থূল দেহের সমন্বয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ জন্য স্থূল দেহের পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতাই যথেষ্ট নয়। বরং একই সাথে আভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা, অন্তরের সর্ব প্রকার মলিনতা, অপরিচ্ছন্নতা হতে পবিত্রতা লাভের নামই তাসাউফ। একে তাযকিয়ায়ে নাফস বা মনের নিষ্কলুষতা বলে। ইলমে তাসাউফকে ইলমে হাকীকাত বা ইলমে ত্বরীকতও বলা হয়। এর অর্থ হলো, অন্তর সর্ব প্রকার অসচ্চরিত্রতা হতে পবিত্র হওয়া এবং সকল প্রকার নিন্দনীয় ও কলুষযুক্ত উদ্দেশ্য হতে পরিচ্ছন্ন হওয়া। (কাশফুয্ যুনুন : ৯/৪১৩)।
পরিপূর্ণ মুসলমান হতে যেমন ঈমান-আকাইদ ও বাহ্যিক আমল সুন্দর হওয়া উচিত, তেমনি বাতেনী বা আত্মিক আমলেরও পরিশুদ্ধ বা তাযকিয়ায়ে নাফস অপরিহার্য। এতদ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : (ক) যে আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা সাধন করেছে সে সফলতা লাভ করেছে। (সূরা আল্ আ’লা : আয়াত ১৪)। ইরশাদ হয়েছে : (খ) তোমরা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দুষ্কর্ম পরিত্যাগ কর। (সূরা আল আনয়াম : আয়াত ১২০)।
ইরশাদ হয়েছে : (গ) নবী উম্মতের আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা দান করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দিবেন। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১৬৪)। ইরশাদ হয়েছে : (ঘ) অবশ্যই সে সফল হয়েছে যে নাফসকে পবিত্র করেছে। আর সে অবশ্যই ব্যর্থ হয়েছে সে একে পাপ পঙ্কিলতায় নিক্ষেপ করেছে। (সূরা আশ শামস : আয়াত ৯)। ইরশাদ হয়েছে : (ঙ) যে পবিত্র হয় সে নিজের জন্যই হয়। আর আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন স্থল। (সূরা ফাতির : আয়াত-১৮)।
মানুষের মধ্যে যেমন দু’টি দিক আছে, একটি জাহির (স্থূল দেহ) এবং অপরটি বাতিন (পবিত্র আত্মা), তেমনি আল্লাহর পথে চলার ও একটি জাহির এবং একটি বাতিন আছে। জাহির বা বাহ্যিকটি শরীয়ত, আর বাতিন বা আভ্যন্তরীণটি তরীকত। শরীয়তের মধ্যেই তরীকত লুক্কায়িত আছে। যেমন দুধের মধ্যেই মাখন লুক্কায়িত। কেউ মাখন লাভ করতে পারবে না তার গোপন ভান্ডার দুধ ছাড়া। উক্ত শরীয়ত, তরীকত ও হাকীকত একটি অপরটির জন্য অত্যাবশ্যক। আর এই তিনটির মূল উদ্দেশ্য হলো বান্দাহর মধ্যে পূর্ণ দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করা। (রাদ্দুল মুহতার : খন্ড ১, পৃষ্ঠা-৪২)।
স্মরণ রাখা দরকার যে, শরীয়ত হলো নির্দিষ্ট পদ্ধতি মতো আমল করা আর তরীকত হলো শরীয়তের পথ চলাকে আল্লাহর পথে অবিচল রাখা। কেননা, নবী এবং রাসূলগণ তিনটি বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। (১) জীবনের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধ একীন আকিদাহ লালন করা, (২) বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে দৈনন্দিন কার্যাবলী ও দায়িত্ব পালন করা (৩) আভ্যন্তরীণ ইহসান ও ইখলাসকে বিশুদ্ধ করা।
তবে, শরীয়তের উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সু²। শরীয়তের সকল বিষয়ের তুলনায় এটা অধিক গভীর। এটি দেহে আত্মার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও শব্দে বা বাক্যে অর্থের স্থলাভিষিক্ত। তাসাউফপন্থী সুফিয়ায়ে কেরাম এই বোঝা ও দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছেন। ফলে, তারা হেদায়েত অনুসন্ধান করে হেদায়েত লাভ করেছেন। তৃপ্তি কামনা করে তৃপ্তি পেয়েছেন। এমন কী প্রান্ত সীমায় পৌঁছারও সবচেয়ে বড় অংশটি অর্জন করার দুর্লভ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। (তাফহিমাতে ইলাহিয়্যা : খন্ড ১, পৃষ্ঠা-১৩)।
তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির একাধিক মাসলাক আছে। যার মধ্যে অধিকতর প্রসিদ্ধ ও মকবুল ৪টি। যথা: (১) নকশাবন্দিয়া, (২) কাদিরিয়্যাহ, (৩) চিশতিয়্যাহ, (৪) মোজাদ্দেদিয়া বা সোহরাওয়ারদিয়্যাহ। এ সকল তরীকার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যস্থল এক ও অভিন্ন। আর তাহলো শায়খ বা মুরশিদের শিক্ষার মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করা।
আত্ম্যাত্মিক পবিত্রতা বা তাসাউফের মূল লক্ষ্য তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন কোনো তরীকায় অতি সহজে, তাড়াতাড়ি অর্জিত হয়। আর কোনো তরীকায় যথেষ্ট শ্রম সাধনার প্রয়োজন হয়। আত্মিক উন্নতীতে এই তরীকা সমূহের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত কিছু পার্থক্য থাকলেও সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক। তবে এটা সুস্পষ্ট যে, সকল সুফিয়ায়ে কেরাম তাদের পরওয়ারদিগারের হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন সকল মুজতাহিদগণ হক ও সত্য হেদায়েতের উপর আছেন। এজন্য কারো উচিত হবে না, অন্যের কথা ও মতাদর্শকে হেয়প্রতিপন্ন করা। (আল ইয়াওয়াকিতু ওয়াল জাওয়াহিরু-খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৯৩)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন