৩. ইমাম যাইনুদ্দীন ইবনে রজব দামেস্কী (৭৯৫ হি.) : ইমাম ইবনে রজব রাহ. তাঁর ‘লাতায়িফুল মাআরিফ ফীমা লিমাওয়াসিমিল ‘আমি মিনাল ওয়াযায়েফ’-এ শবেবরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে-
‘শাবান মাসের পনেরো তারিখে রোজা নিষেধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেননা ওই দিন তো ‘আইয়ামে বীজ’ (চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ)-এর অন্তর্ভুক্ত। আর প্রতি মাসেই আইয়ামে বীজ-এ রোজা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া ১৫ শাবানের রোজা সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র হাদীসও রয়েছে; যদিও এর ‘সনদ’ দুর্বল। সুনানে ইবনে মাজাহ-এ হযরত আলী রা. এর মাধ্যমে বর্ণিত, যখন ১৫ শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে নামাজ পড় এবং সামনের দিনে রোজা রাখ...।’
এরপর শবেবরাতের ফজিলত সর্ম্পকে একাধিক হাদীস উল্লেখ করার পর তিনি লেখেন- ‘সঠিক কথা হচ্ছে এই রাতের ইবাদত ব্যক্তিগতভাবে করা উচিত। এ রাতে নফল নামাজের জন্য মসজিদে ভিড় করা বা মাহ্ফিল করা মাকরূহ।’
তিনি আরো বলেন, ‘একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে যিকির ও দুআর জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া। প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করবে; এরপর মাগফেরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে; আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দুআ করবে এবং নফল নামাজ পড়বে। সবসময় সেসব গুনাহ থেকে বিরত থাকবে যেগুলো ওই রাতের বিশেষ ফজিলত (ব্যাপক ক্ষমা) থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। যেমন শিরক, হত্যা, যিনা, হিংসা ইত্যাদি।’
তিনি আরো বলেন, ‘(ওই রাতের ফজিলত স্বীকৃত তবে) একথা সঠিক নয় যে, সূরা দুখান-এর আয়াতে যে ‘লায়লাতুম মুবারকা’-এর উল্লেখ এসেছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য এই শবেবরাত। কেননা সঠিক এটাই যে, তা দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ : ১৫১/১৫৭)।
৪. ইমাম ইবনুল হাজ্জ (আলমাদখাল গ্রন্থকার ৭৩৭ হি.) : শায়েখ ইবনুল হাজ্জ রাহ. যাঁর গ্রন্থ ‘আলমাদখাল’ বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ ও বিদআত খন্ডনে এবং সুন্নত জিন্দা ও প্রচার প্রসারে উৎকৃষ্ট গ্রন্থাবলির অন্তর্ভুক্ত, তিনি এই গ্রন্থের ১ম খন্ডের শেষাংশে শবেবরাতের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অন্তরের অত্যন্ত দরদ নিয়ে ওইসব বিদআত ও কুসংস্কার সম্পর্কে সবিস্তারে সতর্ক করেছেন, যেগুলো মানুষ শয়তানের ধোঁকা ও প্ররোচনায় এই রাতের ফজিলত লাভের বৈধ পদ্ধতি ছেড়ে অবলম্বন করেছে এবং এখনো করছে।
তিনি বলেন, ‘এ রাত যদিও শবে কদরের মতো নয়; কিন্তু এর অনেক ফজিলত ও বরকত রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরি পুণ্যাত্মারা এই রাতের যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন এবং এর যথাযথ হক আদায় করতেন। কিন্তু আজ সাধারণ লোকেরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টো করে ফেলেছে। তারা রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের পেছনে পড়ে (মনের অজান্তেই) এর খায়ের বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
একে তো ওরা এ রাতে আলোকসজ্জার নিকৃষ্টতম রসম যা অগ্নিপূজকদের প্রতীক, তা আবিষ্কার করেছে; অপরদিকে মসজিদসমূহে সমবেত হয়ে শোরগোল করে পবিত্র পরিবেশকে নষ্ট করেছে। তাছাড়া মহিলাদের কবরস্থানে যাওয়া, তা-ও আবার বেপর্দা অবস্থায়, পাশাপাশি পুরুষদেরও কবর যিয়ারতের নামে ওখানে ভিড় সৃষ্টি করা- এ সব কিছুই নব-আবিষ্কৃত বিদআত এবং নববী সুন্নত ও সলফে সালেহীনের পথ ও পদ্ধতির পরিপন্থী। (আলমাদখাল : ১/২৯৯-৩১৩)।
শবেবরাত সম্পর্কে পূর্বসূরিদের বহু উক্তি রয়েছে। এখানে উদাহরণস্বরূপ কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়লে একদিকে যেমন এই রাতের ফজিলত, এ রাতে ব্যক্তিগত ইবাদত যথা নফল নামাজ, যিকির ও দুআ, তওবা ইস্তেগফার, দরূদ শরীফের অযিফা ও কোরআন তিলাওয়াত প্রভৃতির গুরুত্ব জানা যাবে; তেমনি এ রাতের সেসব রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কার সম্পর্কেও জানা যাবে, যেগুলো মূলত লোকদের এই রাতের প্রভ‚ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে শয়তানের ধোঁকা ও প্ররোচনায় আবিষ্কৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কল্যাণের তাওফীক দান করুন এবং সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে নিরাপদ রাখুন -আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন