ইসলাম ঘোষণা করেছে: ‘লি’কুল্লে দায়িন দাওয়াউন ইল্লাস সাম’ অর্থাৎ আল্লাহপাক প্রত্যেক রোগেরই ওষুধ সৃষ্টি করেছেন, মৃত্যু ব্যতীত। তাই অসুখ হলে চিকিৎসা করার ওপর ইসলাম বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। খোদ রাসুলুল্লাহ (সা.) রোগ নিরাময়ে অসংখ্য দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন এবং পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে বহু বস্তুর উল্লেখ করেছেন। মহামারিকে আরবিতে ‘তাউন’ এবং ‘ওবা’ বলা হয়। মহামারি অর্থে হাদীসে দুটি শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে ‘তাউন’ বা ‘ওবা’-এর ঘটনা ঘটে থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ফারুকী খেলাফত আমলে ‘তাউনে আমওয়াসের বিখ্যাত ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনা তাউন শব্দের কেবল ব্যাপক পরিচিতিই ঘটায়নি, এমনকি ধর্মীয় দিক থেকে দারুণ বিতর্কেরও সূত্রপাত করেছে।
হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে ইমাম আবু জাকারিয়া ইয়াহিয়া ইবনে শরফ নওভি দামেশকি (৬৩১-৬৭৬হি.) সংকলিত ‘রিয়াজুস সালেহীন’ প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থ। এতে তাউনে আমওয়াসের ঘটনাটি ১৭৮৯ নং হাদীসে ৩৪৯ নং অনুচ্ছেদ এইভাবে উল্লেখ করেছেন: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন যে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হন, যখন ‘সার্গ’ নামক স্থানে পৌঁছেন, (মদীনা হতে ১৩ মঞ্জিল দূরে সিরিয়া গমনের একটি মঞ্জিল) তখন তার সাথে সাক্ষাৎ করেন সেনাদলগুলোর নেতৃস্থানীয়গণ। তাদের মধ্যে হযরত আবু উবায়দা ইবনুল র্জারাহ (রা.) এবং তার সঙ্গীগণও ছিলেন, তারা জানান যে, সিরিয়ায় ‘ওবা’ মহামারী দেখা দিয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমাকে উমর (রা.) বললেন, আমার নিকট প্রাথমিক মোহাজেরদের ডেকে আনো। আমি তাদেরকে ডাকলাম এবং তিনি তাদের সাথে পরামর্শ করলেন এবং তারা জানালেন যে, সিরিয়ায় মহামারি দেখা দিয়েছে। এতে তাদের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন, আপনি একটি কাজে বের হয়ে এসেছেন, আমরা মনে করি না, আপনি (যেখান থেকে এসেছেন) সেখানে ফিরে যাবেন। আবার কেউ কেউ বললেন, আপনার সাথে বাকি লোকেরা এবং রসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবীগণও রয়েছেন, আমরা মনে করি না, এ মহামারিতে আমরা সামনে অগ্রসর হব। হযরত উমর (রা.) বললেন, তোমার আমার নিকট হতে উঠে চলে যাও। অতঃপর ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হযরত উমর (রা.) বললেন, আমার কাছে আনসারগণকে ডেকে আনো। আমি তাদেরকে ডাকলাম। হযরত উমর তাদের সাথে পরামর্শ করলেন এবং তারা মোহাজেরদের পথ অনুসরণ করলেন (অর্থাৎ সামনে অগ্রসর হতে) এবং তাদের ন্যায় মতভেদ করলেন। হযরত উমর (রা.) বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে চলে যাও। অতঃপর ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বললেন, মক্কা বিজয়ের সময় মোহাজের কোরেশদের প্রবীণগণ এখানে উপস্থিত আছেন, তাদেরকে আসতে বলো, আমি তাদের ডাকলাম। তাদের কেউ মতভেদ করলেন না। দুইজন বললেন: আমরা মনে করি, সকল লোকসহ আমরা ফিরে যাব এবং এ মহামারির দিকে তাদেরকে ঠেলে দেব না । অতঃপর হযরত উমর (রা.) লোকদের মধ্যে ঘোষণা করলেন: ‘ভোরে আমি প্রত্যাবর্তন করব, তোমরাও তাই করবে’।
উল্লেখিত তিনটি দলের সাথে পরামর্শ করার পর হযরত উমর (রা.) তৃতীয় দলের পরামর্শ অনুযায়ী অগ্রসর না হয়ে সেখান থেকে ফেরত যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এসময় সেনাপতি আবু উবায়দা (রা.) বলে উঠেন, এটি কি আল্লাহর কুদরত হতে পলায়ন নয়? হযরত উমর (রা.) বললেন: ‘হ্যাঁ আমরা আল্লাহর কুদরত হতে আল্লাহর কুদরতের দিকে পলায়ন করছি’।
উভয়ের মধ্যে এরূপ কথা কাটাকাটির পর হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) সেখানে আগমন করেন। তিনি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: তোমরা যখন কোনো ভূ-খন্ডে মহামারির দেখা দেয়ার কথা শুনবে সেদিকে অগ্রসর হবে না। আর যখন কোনো ভূ-খন্ডে তা দেখা দেবে এবং তোমরা সেখানে অবস্থান করবে, তখন সেখান থেকে বের হয়ে পলায়ন করবে না। একথা শুনে হযরত উমর (রা.) আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর তিনি প্রত্যাবর্তন করেন। (বোখারী ও মুসলিম)।
হজরত ওসামা ইবনে জাইদ (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: তোমরা যখন শুনবে কোনো ভূ-খন্ডে ‘তাউন’ (মহামারি) দেখা দিয়েছে, তখন সেখানে তোমরা প্রবেশ করবে না। আর যখন কোনো ভূ-খন্ডে মহামারি দেখা দিবে এবং তোমরা সেখানে অবস্থান করবে, তখন সেখান থেকে বের হবে না। (সূত্র ঐ )
‘মহামারি কবলিত শহর হতে বের হয়ে পলায়ন করা এবং ঐ শহরে প্রবেশ করা মাকরূহ’ শিরোনামে বর্ণিত দুইটি হাদীসের সারমর্ম এই যে, মহামারি কবলিত স্থানে গমন করা যেমন উচিত নয়, তেমনি সেই উপদ্রুত এলাকা হতে সরে যাওয়াটাও অনুচিত। হাদীসদ্বয়ের এ স্পষ্টভাষ্য এবং হাদীস অনুযায়ী, হযরত উমর (রা.)-এর আমলে প্রমাণ করে যে, এ সংক্রামক মহামারি তথা ছোঁয়াচে রোগ হতে আত্মরক্ষার প্রধান উপায় যে যেখানে থাকে সেখানে অবস্থান করা, যাতে এর সংক্রামণ ছড়াতে না পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন