মাস দুয়েক আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৮ লেনের যাত্রাবাড়ী অংশে পাথরের প্রলেপ দিয়ে মেরামত করা হয়। দুমাসের মাথায় সেগুলো ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। নিয়ম অনুযায়ী মোটা পাথরের প্রলেপের উপর কুচি পাথরের প্রলেপ দিয়ে ফিনিশিং করতে হয়। সেটা করা হয়নি। মোটা পাথরগুলো এখন কোথাও উচু কোথাও নিচু হয়ে পুরো মহাসড়কটিকে অসমান করে রেখেছে। এর উপর দিয়েই চলাচল করছে যানবাহন। লকডাউনে মহাসড়কে যান চলাচল কমেছে। তাতেই চোখে পড়ছে মহাসড়কের বেহাল দশা। ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের গুরুত্বপূর্ণ চার লেন মহাসড়কটি এরই মধ্যে ভঙ্গুর দশায় চলে গেছে। সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি ও ওজন নিয়ে চলার কারণে মহাসড়কটিতে সৃষ্টি হয়েছে রাটিং (রাস্তা দেবে যাওয়া বা ফুলে যাওয়া)। বাইন্ডার্স কোর্স ও বিটুমিন কার্পেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেগুলো সংস্কারে সওজ অধিদপ্তরের মোটা অংকের টাকা ব্যয় হচ্ছে। সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার লেনের মহাসড়কটিতে প্রকৌশল ও নকশাগত ত্রæটির কারণে শুধু স্থায়িত্ব কমছে না, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। মহাসড়কের যেসব অংশে রাটিংয়ের পরিমাণ বেশি, সেখানে ওয়্যারিং কোর্সের পুরুত্ব ৬০ মিলিমিটারের কম পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের নকশা প্রণয়নের সময় ধরে নেয়া হয়েছিল, এতে প্রতি বছর গাড়ি চলাচল বাড়বে ৬ শতাংশ হারে। যদিও সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের নির্দেশিকায় সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে যানবাহন চলাচলে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হারে প্রাক্কলনের নির্দেশনা রয়েছে। বাস্তবে দেখা গেল, চালুর পর চার লেনের মহাসড়কটিতে গাড়ির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। ফলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা দিয়েছে রাটিং। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়কের ভিত। এতে করে মহাসড়কটি সংস্কারেও প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একটি মহাসড়কের নকশা প্রণয়নের সময় যেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়, তার অন্যতম হলো ইকুইভ্যালেন্ট সিঙ্গেল এক্সেল লোড (ইএসএএল)। এক্ষেত্রে মহাসড়কটি একসঙ্গে কী পরিমাণ চলাচলরত যানবাহনের চাপ নিতে সক্ষম, সেটিকেই ইএসএএল (১৮ হাজার পাউন্ড) এককে প্রকাশ করে থাকেন প্রকৌশলীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের নকশা প্রণয়নের সময় এর ইএসএএল হিসাব করা হয়েছিল ১৩৩ মিলিয়ন। যদিও বর্তমানের গড় ট্রাফিক অনুযায়ী, মহাসড়কটিতে ইএসএএলের মান দাঁড়িয়েছে ১৭৭ মিলিয়নে, যা প্রক্ষেপণের চেয়ে অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ইএসএএলের ওপর ভিত্তি করেই মহাসড়কের প্রতিটি ধাপের হিসাব ঠিক করা হয়। এক্ষেত্রে লোড নেয়ার ক্ষেত্রে রাস্তার প্রত্যেকটি ধাপ একসঙ্গে কাজ করে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি মহাসড়ক কয়েকটি ধাপে নির্মাণ করতে হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রেও ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয়েছে প্রকৌশলীদের। নকশার তথ্য অনুযায়ী, মহাসড়কের সবচেয়ে নিচের ধাপটি বালিনির্মিত। ইমপ্রুভড সাব গ্রেড নামে পরিচিত ধাপটির পুরুত্ব ৩০০ মিলিমিটার। এর ওপর দ্বিতীয় ধাপে ইটের খোয়া ও বালির মিশ্রণ থাকার কথা ১৫০ মিলিমিটার পুরুত্বের। নকশায় পাথর দিয়ে গড়া পরের ধাপের পুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ মিলিমিটার। প্রকৌশলীদের ভাষায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ দুটিকে একত্রে বলা হয় সাব বেজকোর্স। সাব বেজকোর্সের ওপরে থাকে এগ্রিগেট বেজ। মহাসড়কটির নকশায় পাথরে নির্মিত চতুর্থ ধাপের এ বেজটির পুরুত্ব ধরা হয়েছে ৪০০ মিলিমিটার। এর পরের দুটি ধাপে ব্যবহার করা হয় বিটুমিন। এর মধ্যে নকশায় বিটুমিনাস বাইন্ডার্স কোর্স নামে পরিচিত ধাপটির পুরুত্ব রাখা হয়েছে ১০০ মিলিমিটার। সর্বশেষ ধাপ বিটুমিনাস ওয়্যারিং কোর্সের পুরুত্ব রাখা হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। নির্মাণের সময় আপোস করা হয়েছে মহাসড়কটির ভারবহনের সক্ষমতার ওপরও। দারোগারহাট এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভারবহন সীমা ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৪ টন। যদিও সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে গাড়ির এক্সেলপ্রতি সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২ টন ভারবহনের উপযোগী করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাসড়কের নকশা ও প্রকৌশলগত বিষয়গুলো চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে যানবাহনের চালকদের মনস্তত্তে¡র বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া জরুরি। সাধারণত একটি মহাসড়কে চালকদের রাস্তার মাঝামাঝি অংশ (মিডিয়ান) ঘেঁষে গাড়ি চালানোর প্রবণতা দেখা যায়। এতে করে ওই অংশে বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে সড়কের এ অংশটুকু দ্রুত ক্ষয়ে যায়। এছাড়া সড়কের পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন সক্ষমতা নিশ্চিত করাটাও জরুরি। অন্যথায় পানি জমে সড়কের ভীতকে দুর্বল করে দেয়। একপর্যায়ে সড়ক নষ্ট হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশে নির্মিত চার লেনের সড়কগুলোয় এসব বিষয় যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, এরই মধ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে শিমরাইল পর্যন্ত কয়েকটি স্থানে মহাসড়কটি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত তৈরী হয়েছে। এসব সংস্কার করতে গিয়ে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, আমাদের দেশের বাস্তবতায় মহাসড়ক নির্মাণের সময়ই একটি বা দুটি লেয়ার করে সেটিতে যান চলাচল করতে দেয়া হয়। এতে নির্মাণকালেই মহাসড়কের লেয়ারগুলোর ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কিউরিং পিরিয়ড। পেভমেন্ট নির্মাণের পর কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। সেটিও আমাদের দেশে মেনে চলা সম্ভব হয় না। এসব কারণেই নির্ধারিত আয়ুর আগেই সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। মেঘনা-গোমতী সেতুর সংযোগ সড়কের উদাহরণ টেনে তিনি আরো বলেন, সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় এর ঠিকাদাররা এ কিউরিং পিরিয়ড অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনেছিল। এতে সাময়িকভাবে সাধারণ মানুষের কষ্ট হলেও আমরা টেকসই একটা সড়ক পেয়েছি। বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এ ধরনের চর্চা অত্যন্ত জরুরি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক প্রকল্পটি ২০০৫ সালে যখন প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হয়, তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কাজ শেষ করতে করতে এ ব্যয় গিয়ে ঠেকে ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকায়। টাকার অংকে ‘বড়’ এবং অর্থনৈতিক করিডোর বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হওয়া সত্তে¡ও মহাসড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল করে তুলছে সরকার। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৩০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠবে শিল্পনগরটি। পরিপূর্ণভাবে চালু হলে এখানকার সিংহভাগ গাড়ির চাপ গিয়ে পড়বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণের সময় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও শিল্পায়ন সম্ভাবনাকে আমলেই নেয়া হয়নি। নির্মাণকালে মহাসড়কটির এসব অসঙ্গতিকে নিজেদের ‘সীমাবদ্ধতা’ হিসেবে অভিহিত করছেন সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরকে বলা হয় দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। এই লাইফলাইনকে সচল রাখতে সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা থেকে সরে এসে হাইস্পিড রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে করে এ মহাসড়কে চাপ আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতে এই করিডোরকে সচল রাখার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আরো প্রশস্ত করার পাশাপাশি সার্ভিস লেন যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সওজ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সওজ অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বলেন, আমরা সবার আগে প্রকল্পটির জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করব। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার এ কাজ করার জন্য বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি) প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শেষ হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নেব। এসব কাজ কিছুটা সময়সাপেক্ষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন