ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট এ তো নতুন কিছু নয়! কিন্তু এই মহাসড়কটিকে ঘিরে বিগত দিনের উন্নয়নের পরও কেন এত যানজট? দিনের পর দিন এসব যানজটে ভোগান্তিও অনেক। যাত্রা শুরুর পর কখন গন্তব্যে পৌঁছাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সাম্প্রতিককালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘন ঘন যানজট তৈরি হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষসহ সকলেই। কিন্তু মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত এবং মহাসড়কের মেঘনা, গোমতী ও শীতলক্ষ্যায় নতুন চার লেনের তিনটি ব্রিজ করার পরও কেন বারবার যানজটে ভুগতে হচ্ছে এই মহাসড়ক ব্যবহারকারী মানুষদের?
এর কারণ খুঁজতে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত দেশের একমাত্র আট লেনের মহাসড়ক। তাই রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠলাম। পরবর্তী আধাঘণ্টায় কাঁচপুর সেতু পার হয়ে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকার কাছাকাছি যাওয়ার পরই প্রথমবারের মতো দীর্ঘ যানজটের মুখোমুখি। যতদূর চোখ যায় বাস, ট্রাক লরিসহ শতশত যানবাহন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মহাসড়কে।
তিশা পরিবহনের বাস চালক জাহিদ হাসান বলেন, প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তারা একই স্থানে আটকে আছেন। জ্যাম ছাড়ছে না। সড়কে চলাচলরত সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে। কুমিল্লা থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক কোরবান আলী বলেন, কুমিল্লা থেকে মেঘনা ব্রিজ পার হয়ে একটু এগোতে যানজটে পড়েন। ১০ মিনিটের জায়গা পেরোতে সময় লেগেছে ১ ঘণ্টা। স্টারলাইন পরিবহনের চালক মনির হোসেন জানান, মেঘনা ব্রিজ পার হওয়ার পর ৫ মিনিট চললে, ১০ মিনিট বসে থাকে। বাধ্য হয়ে আমাদেরও অপেক্ষায় থাকতে হয়।
মনে করেছিলাম, ব্রিজের আগে এই যানজটের কারণ টোল আদায়ে ধীরগতি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। দেখা গেলো, মেঘনা ব্রিজের টোল প্লাজার ৮টি লেন থেকে যানবাহনগুলো যখন ব্রিজ পাড় হয় তখনি তৈরি হচ্ছে যানজট। যার ফলে মেঘনা ব্রিজ পাড় হয়ে মদনপুর চৌরাস্তা এলাকায় প্রতিনিয়ত মহাসড়কটিতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনা সেতুর টোলপ্লাজা এলাকা থেকে সাইনবোর্ড ও এশিয়ান হাইওয়ে (ঢাকা-বাইপাস) সড়কের মদনপুর চৌরাস্তায় সকাল ও সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলের সময় এখানে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
এ সময় ট্রাফিক পুলিশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ করে চাষাঢ়া-সাইনবোর্ড সড়কে চলাচলকারী গাড়িগুলোকে যাতায়াতের সুযোগ করে দিতে হয়। এছাড়া মহাসড়কের মদনপুর চৌরাস্তায় ৮টি অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে প্রতিনিয়ত যানজটের কবলে পড়ছে মহাসড়ক। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে যানজট নিরসন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্থানীয়রা জানায়, মদনপুর চৌরাস্তা এলাকার ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা, বেবীট্যাক্সি ও সিএনজি চলাচল করে থাকে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলোপাথারীভাবে মদনপুর চৌরাস্তায় প্রায় শতাধিক মিনি যানবাহন রাখার ফলে প্রতিনিয়ত যানজটের কবলে পড়ছে মানুষ। মহাসড়কে দীর্ঘক্ষন যানজট লেগে থাকে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত এ মহাসড়কটিতে প্রতি ১০ মিনিট পরপর সাইনবোর্ড মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে একদিকের গাড়ি থামিয়ে অন্যদিকের গাড়ি চালু করতে হচ্ছে।
এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্টদের দাবি, সাইনবোর্ড ও মদনপুর চৌরাস্তায় একটি ইউলুপ তৈরি করলে অনাকাঙ্খিত এ যানজট দূর করা সম্ভব। নারায়ণগঞ্জের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর কামরুল ইসলাম বলেন, সাইনবোর্ড মোড়ে একটি ইউলুপ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। তা না হলে আট লেনের এ মহাসড়কের সুবিধা পাচ্ছেন না যাত্রীরা। মেঘনা সেতু থেকে বর্তমানে কুমিল্লা যেতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা এবং চট্টগ্রাম যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগলেও আট লেন প্রকল্পের সাত কিলোমিটার রাস্তা পার হতে যানজটের কারণে কখনো কখনো এক থেকে দেড় ঘণ্টাও লেগে যায়।
এশিয়া লাইন পরিবহনের চালক আনোয়ার হোসেন বলেন. সাইনবোর্ড এলাকায় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট মহাসড়ক দখল করে অনাবিল নামে গাজীপুরগামী পরিবহন কোম্পানির বাস ডিপো করেছে। একইভাবে কাঁচপুর ব্রিজের নিচ থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত সড়কের একটি লেন দখল করে আছে রজনীগন্ধা নামে পরিবহন কোম্পানি। আর শনির আখড়া এলাকায় সকালে গাবতলী থেকে চিটাগাং রোডে চলাচলকারী শ্রাবণ পরিবহনের মিনিবাসগুলো দুই থেকে তিনটি লেন দখল করে যাত্রী উঠানোর প্রতিযোগিতা শুরু করে। এতেও উল্লেখিত স্থানগুলোতে প্রচণ্ড যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
যানযটের বিষয়ে কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদ পারভেজ ইমরানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, যানজট সবসময় থাকে এটা ঠিক না। তবে যখনি যানজট শুরু হয় তখনি তা পৌঁছে যায় অসহনীয় অবস্থায়। এটি দেশের মূল বাণিজ্যিক রোড হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ সকলেই। আমাদের মালামাল এখন কুমিল্লা থেকে ঢাকাসহ অন্যান্য গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগছে দ্বিগুণ। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। গাড়ি ভাড়াও বেড়েছে। আমরা হিসেব করে দেখেছি, শুধু এই যানজটের কারণেই কেজি প্রতি বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট কমাতে ২০১১ সালের জুলাই মাসে যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত আট লেন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে নয়টি প্যাকেজে সাড়ে সাত কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে সময় লেগেছে সাড়ে চার বছর। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক যাতায়াত নির্বিঘ্ন হয়েছে।
আট লেন প্রকল্প উদ্বোধনের আগে ২০১৬ সালের আগস্টে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সাইনবোর্ড, কাঁচপুর এবং মদনপুর এলাকায় তিনটি ইউলুপ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে কেবল কাঁচপুর ব্রিজের পূর্ব প্রান্তে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের জন্য একটি আন্ডারপাসের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও মদনপুর চৌরাস্তায় এখন পর্যন্ত ইউলুপ বা আন্ডারপাস নির্মাণ না হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.মেহেদী ইকবাল জানান, সাইনবোর্ড থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত চার লেনের রাস্তাটি ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ হচ্ছে। ৪৫০ কোটি টাকার এ প্রকল্পে একই সঙ্গে সাইনবোর্ড মোড়ে একটি ইউলুপ নির্মাণের কথা রয়েছে এবং মদনপুর চৌরাস্তায় ইউলুপ বা আন্ডারপাস নির্মাণের ব্যাপারে একটি প্রস্তাবণা মন্ত্রণালয়ে জমা আছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন