বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সমতল ও সমুদ্রসৈকত ৩১০ কিলোমিটার, সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট-বড় দ্বীপমালা মিলে ২৭৫ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত, এই উপকূলেই রয়েছে দেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা। বিশ্বের সেরা গহীন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের অন্যতম অখন্ডিত সমুদ্রসৈকত বা বেলাভূমি কক্সবাজার অবস্থিত। দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির একটা বিশাল অবদানও এই অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্তে¡ও এই অঞ্চলের অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানা দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলটি তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত (ক) পূর্ব অঞ্চল (খ) কেন্দ্রীয় অঞ্চল (গ) পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল। গঙ্গার জোয়ার সমভূমি হিসাবে পরিচিত পশ্চিমাঞ্চলটি আধা-সক্রিয় ব-দ্বীপ নিয়ে গঠিত এবং বহু চ্যানেল এবং খাঁড়ি দ্বারা ক্রস করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি সক্রিয়তা এবং ক্ষয়ের সবচেয়ে সক্রিয় এবং ক্রমাগত প্রক্রিয়া। এই অঞ্চলটিতে মেঘনা নদীর মোহনা অবস্থিত। পূর্ব অঞ্চলটি পাহাড়ী অঞ্চল দ্বারা আচ্ছাদিত, যা আরও স্থিতিশীল। উপকূলরেখাটি ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা জঙ্গলের সমতলসহ বিভিন্ন পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ইন্টারফেসের সমন্বয়ে গঠিত। প্রায় ৭০টি দ্বীপ, স্বীকৃত জমি, সৈকত, একটি উপদ্বীপ, পল্লী জনবসতি, নগর ও শিল্প অঞ্চল এবং বন্দর নিয়ে গঠিত উপকূলীয় অঞ্চল। উপকূলীয় বাসিন্দাদের বেশিরভাগই দরিদ্র এবং সমগ্র জনগণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট বিপদ উভয়েরই সংস্পর্শে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন পরিচালিত ঘটনা যেমন সমুদ্র স্তর বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, ভারী বৃষ্টিপাত, উপকূলীয় জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং ভূমি ক্ষয় প্রধান প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালে আইলা পর্যন্ত সময়ের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোট ৪৭৮ বার মাঝারি ও মোটাদাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ৪০ বছরে ১৪৯টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ সিডর আর আইলার আঘাতে সুন্দরবনও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রথম ও প্রত্যক্ষ শিকার সব সময়ই। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতি সবচেয়ে ক্ষতির শিকার।
ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভবিষ্যতে আরও ঘন এবং তীব্র হবে। ভৌগোলিক পরিস্থিতি, ঘন জনসংখ্যা এবং দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ুর দুর্বলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কারণ পশ্চিমাংশটি বেশিরভাগ সুন্দরবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে তবে এটি নিচু ভূমির অঞ্চল, অন্যান্য কেন্দ্রীয় অংশটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আরও গতিশীল অংশ।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুণগত ও কার্যকরগত পরিবর্তন সময়ের প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট। স্বাধীনতা লাভের পর এতদিনে দেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে যতগুলো পরিবর্তন তথা সাফল্যজনিত সূচক শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অন্যতম। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময় চাষাবাদযোগ্য ২৫৫ লাখ একর জমিতে ১০০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হতো, সে তুলনায় ২০০৮ সালে জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়ালেও এ সময় ২৬১ লাখ একর জমিতে ধান উৎপাদিত হয়েছে ২৯০ লাখ মেট্রিক টন অর্থাৎ প্রায় তিন গুণ।
দ্বিগুণ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য তিন গুণ বর্ধিত খাদ্যশস্য উৎপাদন নিঃসন্দেহে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি বা সাফল্য। ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৮ সময়ে বাজেটে ক্রমান্বয়ে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ যথেষ্ট হ্রাস (১৯ থেকে ৭ শতাংশ) পাওয়া সত্তে¡ও এই প্রবৃদ্ধি একটি নীরব বিপ্লবের সাক্ষ্য বহন করে আর এর অগ্রসাধক হলো দেশের কৃষক সমাজ।
এই প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির অবদান তুলনামূলকভাবে নিম্নমুখী। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিখাত প্রধানত শস্য ও অশস্য (নন ক্রপ)-এ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত হওয়ার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন তুলনামূলকভাবে এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়নি। একটি পরিশীলিত সমীক্ষা-গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যবর্তী মাত্র ১৩ বছরে জাতীয় পর্যায়ে যেখানে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ শস্য (খাদ্য ও অর্থকরী ফসল) উৎপাদিত হয়েছে, সেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে একই সময় শস্য উৎপাদন বাড়েনি বরং কমেছে। ফলে উপকূলীয় নদ-নদীর ভাঙনপ্রবণ অঞ্চল চিহ্নিত করে বাঁধ নির্মাণ এবং পুরনো বাঁধ সংস্কার জরুরি। ক্ষেত্রবিশেষে ছয় থেকে সর্বোচ্চ দশ মিটার পর্যন্ত বাঁধ উঁচু করতে হবে। উপকূলীয় বাঁধগুলো টেকসই এবং নির্মাণ কাজে যথাযথ তদারক করা হলে আগামী ১০০ বছরেও এই বাঁধের কোনো ক্ষতি হবে না। টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলে উপকূল এবং উপকূলের চর ও চরাঞ্চলগুলোর জীবন ও জীবিকার গতিপথ ত্বরান্বিত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিমাপ করা হলেও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গতিপ্রকৃতি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে এখনই উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কথা ভাবতে হবে। সংরক্ষিত ও সমৃদ্ধ উপকূল গড়ে উঠলে মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে। সমৃদ্ধ উপকূলে মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠবে।
এসডিজির টেকসই উন্নয়নের তিনটি মাত্রা। যথা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত। এগুলোর ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। সম্পদ ব্যবহার এবং বৃদ্ধি থেকে একাধিক পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করে, কীভাবে মহাসাগর, সমুদ্র এবং উপকূলীয় অঞ্চলে সরবরাহিত পরিষেবাগুলোর টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সে সম্পর্কে নীতি ও নির্দেশিকা প্রণয়ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। উপকূলীয় পর্যটন, মৎস্যজীবী ও উপকূলীয় অর্থনীতি এবং জীবিকার অনেকগুলো পরিষেবার একটি টেকসই বিধানের জন্য কার্যকর উপকূলীয় বাস্তুশাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল।
উপকূলীয় অঞ্চলগুলো থেকে মানুষ অনেক সুবিধা অর্জন করে, বিশেষত স্বল্পোন্নত উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপসমূহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে। একই সময়ে, উপকূলীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মানব ও পরিবেশগত চাপ উপকূলীয় ব্যবস্থাগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। তাই বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় অঞ্চলে জরুরি মনোযোগ প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ টেকসই উন্নয়নের জন্য এজেন্ডা (এখন থেকে ২০৩০ এজেন্ডা) মহাসাগর, সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহারের লক্ষ্যে উপকূলীয় অঞ্চলকে তার দুটি লক্ষ্যে স্পষ্টভাবে বিবেচনা (১৪.২ এবং ১৪.৫) করা আছে। উপকূলীয় বাংলাদেশের একটি অঞ্চল নির্দিষ্ট কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা পূর্ববর্তী বেশ কয়েকটি উদ্যোগ এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নীতি ও কর্মসূচিতে স্বীকৃত ছিল। ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (আইসিজেডএমপি) প্রকল্পটি পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়েছিল। প্রকল্পের অন্যতম প্রধান ফলাফল হলো উপকূলীয় অঞ্চল নীতি, যা সরকার কর্তৃক ১৭ জানুয়ারি ২০০৫ এ অনুমোদিত হয়েছিল এটি উপকূলীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য দিক নির্দেশনা দেয়। উপকূলীয় উন্নযন কৌশল (সিডিএস) উপকূলীয় অঞ্চল নীতি বা¯তবায়নের উপর জোর দেয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি আইসিজেডএমপিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় পরিচালনা কমিটির দ্বিতীয় সভায় সিডিএস অনুমোদিত হয়।
উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে আমরা বিভিন্নভাবে কাজে লাগাতে পারি। যেমন- ১. সমুদ্র তীরে বা অগভীর সমুদ্রে বা চরাঞ্চলে সোলার প্যানেল স্থাপন করে বা বাতাস কল ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে। ২. উপকূলবর্তী অঞ্চলে সামুদ্রিক ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে জোয়ার ভাটায় বিদ্যুৎ উৎপাদন। ৩. সামুদ্রিক ঢেউ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ৪.মহাসামুদ্রিক তাপীয় শক্তি মহাসমুদ্রের গভীরের শীতল জল এবং নিরিক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রের উপরিভাগের উষ্ণ জল এর তাপমাত্রার তফাৎ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ৫. জীবাশ্ম জ্বালানি সংগ্রহ করে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা যায়।
যেহেতু সমুদ্রের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বিদ্যমান উপকূল ভিত্তিক শিল্পাঞ্চল বা বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন উপকূলীয় মানুষের জীবন মানের পরিবর্তন হবে অন্যদিকে সমুদ্রের মাধ্যমে মুক্ত সমুদ্রের সুফল ব্যবহার করা যাবে। ফলে এই শিল্পাঞ্চলগুলোতে বিদেশি বিনোয়োগে আকৃষ্ট করানো যাবে এবং বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের এক বিশাল সম্ভাবানা সৃষ্টি হবে। এর পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে প্রক্রিয়াজাত মাছের কারখানা দেওয়া যেতে পারে। কারণ, শুধু মাত্র সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার ফলে একটা সামুদ্রিক মাছের বিশাল বাজার আমরা হারাচ্ছি।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, দ্যা এনভায়রনমেন্ট রিভিউ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন