শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

শিক্ষাদীক্ষায় শাসন: বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি কোনোটাই নয় কাম্য

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০২১, ১২:০১ এএম

শিক্ষার সাথে শাস্তিদান অঙ্গাঙ্গিভাবে জাড়িত। এ দুটির সম্পর্ক সুগভীর ও সুনিবিড়। কদাচিৎ ব্যতিক্রম বাদে দ্বিতীয়টি ছাড়া প্রথমটি হয়েই উঠে না। আবহমানকাল থেইে এমনটি হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ বাণীটি হলো, ‘আযযরবু লিছ্ছিবয়ান কালমাই ফিল বুস্তান।’ অর্থ্যাৎ বাগান ও শষ্যক্ষেতের জন্য পানি যেমন উপকারী ও অপরিহার্য, ছাত্রের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যও শাস্তিদান তেমন উপকারী ও অপরিহার্য। পানি বিহীন বাগান যেভাবে মরে শ্মশানে পরিণত হয়, সেভাবে শাস্তিদান বিহীন শিক্ষা ব্যবস্থাও প্রাণহীন এক পাঠ ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এ জন্যই অনেক সময় শাস্তিকে শিক্ষার প্রতিশব্দ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বলা হয়, তাকে ‘উচিত শিক্ষ দিতে হবে’, মানে তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। এটা সম্ভবত এ কারণে যে, শিক্ষাদান করতে গেলে সাধারণত শাস্তির প্রয়োজন হয়েই থাকে। তা যে কোনো ধরনের শাস্তিই হোক না কেন। কেউ শিক্ষিত হয়েছে, অথচ তাকে কখনও কোনোও রকমের শাস্তি দিতে হয়নি, এমন ঘটনা কদাচিৎই ঘটে। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শিক্ষার জন্য শাস্তিদানের প্রয়োজন এক অনঃস্বীকার্য বাস্তবতা। কেউ অস্বীকার করলে তা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এর জন্য দরকার খুব সচেতনতা ও গভীর বিচার-বিবেচনা। স্থান-কাল-পাত্র,মাত্রা ইত্যাদির দিকে নজর রাখা অত্যান্ত জরুরী। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা রাখা হয় না। ফলে শাস্তি প্রয়োগে চরম বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। অতিরিক্ত শাস্তিদান কখনও সুফল বয়ে আনে না। অতিরিক্ত শাস্তি অনুপস্থিতি ও প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পালানোর সংখ্যাই বৃদ্ধি করছে। যা হরহামেশাই আমরা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি। কেবল মাত্রারিক্ত শাস্তির কারণেই কত ছাত্র মাঝপথে বা সূচনাপূর্বেই হারিয়ে গেছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। এ ব্যর্থতার দায় কে নিবে? এ জন্য প্রথমেই চিন্তা করা দরকার শাস্তিদানের উদ্দেশ্য কি? কেন তাকে শাস্তি দেওয়া হবে? উদ্দেশ্য না জেনে শাস্তি দিলে কেবল মনের ক্ষোভ ও ঝালই মিটে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। উদ্দেশ্য যদি হয় তরবিয়ত ও ব্যক্তি গঠন, তাহলে শাস্তিদানের আগে বেশ কিছু করণীয় থাকে। প্রথমেই প্রয়োজন, যাকে তরবিয়ত দেওয়া হবে তাকে পর্যবেক্ষণ করে নেওয়া। তার রুচি-মেজাজ, মেধা, সাস্থগত, পারিপাশির্^ক অবস্থা ইত্যাদি সবকিছুই ভালভাবে দেখে কর্ম পদ্ধতি স্থীর করা। কারণ সকল শিক্ষার্থী সমমানের হয় না। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় তাদের মাঝে পার্থক্য থাকেই। শিক্ষক ও অভিভাবকের তা ভুলে গেলে চলবে না। পাঠদান ও অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অবস্থাগত পার্থক্যের প্রতি লক্ষ্য রাখলে তাদের কারও প্রতি সাধ্যাতীত ভার চাপানো হবে না। বহনযোগ্য হওয়ার কারণে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সকলেই স্বীয় পাঠ্যবিষয় আয়ত্ত করবে ও অন্যান্য কর্তব্যকর্ম পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। আর এ কথা সকলেরই জানা, সে¦াৎসাহে কৃতকার্যের ফল জলদিই হয়ে থাকে। ফলে শাস্তিদানের প্রয়োজনীয়তা একেবারেই কমে আসে। কেবল দরস দান ও কাজ দেওয়াতেই একজন আদর্শ শিক্ষ ও চৌকস অভিভাবকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তার পরিচর্যাও জরুরী। অর্থাৎ অর্পিত কাজ সঠিকভাবে সে পালন করছে কি না? না করে থাকলে কেন করছে না? তার সমস্যা কোথায়? সমস্যা কি শাস্ত্রগত, না শাস্তগত. না অভ্যাসগত, নাকি পারিবারিক? এ সকল বিষয় খতিয়ে দেখাও একজন আদর্শ শিক্ষক ও বিচক্ষণ অভিভাবকের অবশ্যকর্তব্য। সমস্যা শনাক্ত করার পর তা নিরসনের জন্য উপযুক্ত ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সুফল অবশ্যই পাওয়া যাবে এবং শাস্তিদানের অবকাশও বহুলাংশে হ্রাস পাবে ইনশাআল্লাহ। এ সত্য বিস্মৃত হওয়ার অবকাশ নেই যে, সর্বপ্রকার চেষ্টার পরও মেধার দুর্বলতা ও অলঙ্গনীয় পারিপাশির্^কতার কারণে কাঙ্কখিত ফলাফল লাভ নাও হতে পারে। সে জন্য শিক্ষার্থীকে তিরস্কৃত ও শাস্তির যোগ্য মনে করার কোনো অবকাশ নেই। এ সত্য বিস্মৃত হওয়ায় অনেক ছাত্রকেই শিক্ষক বা অভিভাবক কর্তৃক নিগৃহের শিকার হতে হয়। এটা খুবই দুঃখজনক। মনে রাখতে হবে, মেহনত ও পরিশ্রমের ফলাফল আসে ছাত্রের মেধা ও প্রতিভা অনুযায়ী; মা-বাবা বা উস্তাযের স্বপ্ন অনুযায়ী নয়। এটাই বাস্তব সত্য। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। শিক্ষক ও অভিভাবককে কঠোরতার উপর কোমলতাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। শাস্তি ও কঠোরতা হবে শেষ অস্ত্র। যতক্ষণ কোমলতায় কাজ হয়, ততক্ষণ সে অস্ত্র পরখের বৈধতা থাকে না। দয়া ও মমত্বপর্ণ আচরণ ছাত্রকে লেখা-পড়ায় উদ্দীপ্তি করে। মনে অনুপ্রেরণা যোগায়। ফলে কাজ করে উদ্দীপনা ও আন্তরিকভাবে। আর এ অবস্থায় কাজ হয় সুচারু ও নিখুঁত। কাজেই প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে যথাসম্ভব শিক্ষার্থীকে স্ফূর্তির ভিতর রাখা আবশ্যক। ভুল তার দ্বারা হতেই পারে। সেক্ষেত্রে তাকে ন¤্রতার সাথে বোঝাতে হবে। দরদী ভাষা ব্যবহার করতে হবে। এক হাদীসের ভাষ্য মতে আল্লাহর শানও এমনই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমার দয়া আমার ক্রোধের উপর অগ্রগামী থাকে।’ [বুখারী, হাদীস: ৭৫৫৩; মুসলিম, হাদীস: ২৭৫১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের শিক্ষাদান পদ্ধতিতেও আমরা দয়া ও দরদেরই প্রাবল্য দেখতে পাই। হাদীস শরীফে তাঁর শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোমলতা ও দরদী আচরণের অনেক ঘটনাই বর্ণিত হয়েছে। একটি ঘটনা হলো, ‘একবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামসহ মসজিদে নববীতে বসা ছিলেন। এ অবস্থায় এক গ্রাম্য লোক এসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। এরপর সে মসজিদের এক পাশে গিয়ে পেশাব করতে শুরু করলেন। সাহাবায়ে কিরাম এটি দেখে তাকে ধমকাতে লাগলেন এবং তার দিকে তেড়ে গেলেন। তা দেখে তিনি তাদেরকে এমন আচরণ করতে বারণ করলেন। যখন তার পেশাব করা শেষ হলো, তিনি তাকে কাছে ডাকলেন। [কোনো ধমক বা কঠোর আচরণ না করে কোমল ভাষায়] তাকে বললেন, দেখ, এ মসজিদ এমন স্থান নয়, যেখানে পেশাব করা যাবে; বরং এটা নির্মিত নামায পড়ার জন্য, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল ও কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য। তারপর তিনি সাহাবায়ে কিরামকে আদেশ করলেন, বালতিতে করে পানি এনে উক্ত স্থানে ঢেলে দাও। [ তাঁর এ দরদী ও কোমল আচরণে মুগ্ধ হয়ে] বেদুঈন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলল, আপনার উপর আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ হোক। পরবর্তীতে সে বলত, তিনি আমাকে একটু তিরস্কারও করলেন না; একটু গালিও দিলেন না।’ [বুখারী, হাদীস: ২২০; নাসায়ী, হাদীস: ৫৬] আমরা সাধারণত এ হাদীসের একটি দিক নিয়েই আলোচনা করি থাকি। তাহলো মাটিতে পেশাব বা অন্য কোনো তরল নাপাকি পড়লে তা পবিত্র করার উপায় কি? এ হাদীস থেকে তার সমাধান নেওয়া হয় এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনাও হয়। কিন্তু এ হাদীসের আরও একটি দিক আছে, যার দিকে আমরা সাধারণত নজর দেই না। এই হাদীসে শিক্ষাদানের এক গুরুত্বপর্ণ নীতি বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে, শিক্ষার্থীর সাথে কোমল ও দরদী আচরণ করা। তাদের কোনো ভুল হলেই চটে না যাওয়া কিংবা আঘাত না করা। তাহলে এর ফল হবে সুদূর প্রসারী। যেমনটি দেখেছি হাদীসে বর্ণিত বেদুঈনের বেলায়। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ছিলেন মানব ও মানবতার মহান আদর্শ শিক্ষক। মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে তার আদর্শ। ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি যে কালেই তাঁর সে মহান আদর্শ অনুসরণ করেছে সফলতা তাদের পদচুম্বন করেছে। আজও তা আপন আলোয় দ্যদীপ্যমান। হালে অনেক অমুসলিম রাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের শিখানো কোমল ও সহনশীল পন্থ অবলম্বন করছে। এর সুফলও তারা পেয়েছে। (চলবে)
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস ও মুফতী জামিয়া মিফতাহুল উলুম, নেত্রকোনা

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন