জুনের ২ তারিখ দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পাতায় সউদি আরবের মসজিদগুলোতে মাইক ব্যবহারের নয়া নীতিমালা বিষয়ে সউদি সরকারের একটি ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে মুসলমানদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ বলছেন এটা ইসলামবিদ্বেষীদের ভাবনার ছাপ। আজানের শব্দ অপছন্দকারী গোষ্ঠীর প্রভাব। এ মনোভাবটি আপন জায়গায় সম্পূর্ণ সঠিক তবে এখানে বিষয়টির বাস্তব কারণটিও দেখা চাই। ইতিবাচক চিন্তার সুযোগ থাকলে শুরুতেই মন্দ দিকটি সামনে আনার দরকার পড়ে না। যেমন আরেকদল মানুষ সউদি ধর্মমন্ত্রণালয় ও সিনিয়র শায়খ কমিটির ব্যাখ্যায় যৌক্তিকতা খুঁজছেন। তারা ইসলামী শরীয়তের ভারসাম্যপূর্ণ নীতির আলোকে এ নির্দেশনাটিকে দেখছেন এবং সউদি সরকারের ব্যাখ্যাটি অনুধাবন করছেন।
এখানে আমরা নির্মোহভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে চাই। নীতিমালা ও নির্দেশনায় বলা হয়েছে, একটি মাইকের সর্বোচ্চ ভলিউমের তিনভাগের দুইভাগ বা এরচেয়ে কম আওয়াজে আজানের সময় মাইক ব্যবহার করা যাবে। মানে ফুল ভলিউমের ৬৬% ভলিউমে। এরচেয়ে বেলি ভলিউম স্বাস্থ্য, পরিবেশ, আজানের ভাবগাম্ভীর্য ও মাহাত্ম্যের জন্য ক্ষতিকর। এ বিষয়ে মসজিদে কোবার সম্মানিত ইমামের একটি টিভি সাক্ষাতকারে গোটা নির্দেশনাটির কারণ, যৌক্তিকতা ও মাসআলা উঠে এসেছে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ওয়াক্তিয়া নামাজে মসজিদের ভেতর, বারান্দা ও সাহান (অভ্যন্তরীণ চত্বর) ছাড়া গোটা মহল্লার মাইক চালু করা যাবে না। অর্থাৎ আজানের মাইকে নামাজের জামাত প্রচার করা যাবে না। মসজিদের মুসল্লিদের প্রয়োজন পরিমাণ ৩৩% মানে তিনভাগের একভাগ ভলিউমে নামাজ চলবে। কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ফজরের সময় দীর্ঘ কিরাত আজানের মাইকে প্রচার করলে শিশুরা ঘুমাতে পারে না। যাদের ওপর নামাজ ফরজ হয়নি।
এ বিষয়টি শরীয়তের ব্যবহারিক বিধান অনুযায়ী ঠিকই আছে। কারণ আজান ইসলামের প্রতীক। এটি যেমন নামাজের ঘোষণা তেমনি এর ধর্মীয় আধ্যাত্মিক গুরুত্ব সর্বোচ্চ। ইসলামের প্রথম যুগে মসজিদে নববীর আজান মদীনা নগরীকে কাভার করত। মুয়াজ্জিন নিজের কানে আঙ্গুল রেখে সামনে, ডানে, বামে মুখ ফিরিয়ে প্রতিটি বাড়িতে নামাজের এবং কল্যাণের আহবান পৌঁছে দিতেন। এ কাজটি মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার একটি জরুরি অনুসঙ্গ। তখন আজকের মসজিদে নববী এলাকাটিই ছিল পূর্ণাঙ্গ মদীনা নগরী। শরীয়তের চলমান বিধান হচ্ছে, একটি মসজিদের আওতায় যতগুলো বাড়িঘর বা জনবসতি রয়েছে এতটুকু জায়গার মানুষকে নামাজের জন্য আহ্বান করা।
এখানে নিজের মহল্লা পার হয়ে আরও বহু দূরে আজানের শব্দ পৌঁছানো, পার্শ্ববর্তী মসজিদগুলোর আজানের সাথে কাটাকাটি, একই সাথে একজন নামাজির ৬/৭টি আজান শোনা এবং একজন মানুষের উচ্চস্বরে আহ্বানের চেয়ে দশগুণ বেশি আওয়াজে একই সময়ে ৬/৭টি আওয়াজ শোনা কি শরীয়তের চাহিদার চেয়ে বেশি কিছু নয়? ইসলাম বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি মুক্ত একটি মধ্য নীতির জীবনব্যবস্থা। শরীয়তের পরিভাষায় যাকে বলে, দীনুন ওয়াসাতিয়্যুন মু’তাদিলুন বাইনাল ইফরাতি ওয়াত তাফরীত।
আহ্বান হওয়া উচিত মসজিদের আওতাধীন নিকটবর্তী অঞ্চলের নামাজীদের জন্য এলার্ম। উদাস ও ব্যস্ত নাগরিকদের জন্য আল্লাহর বড়ত্ব, তাওহীদ, রিসালাত, নামাজ ও সামগ্রিক কল্যাণের প্রতি দাওয়াতের পাশাপাশি ঈমানী আহ্বান। তবে এটি কোনোক্রমেই উচ্চ শব্দ, অপরিকল্পিত শব্দ সংঘাত, আজানের মহান বার্তার ধ্বনি বিভ্রাট, এলোমেলো ও অসুন্দর শব্দজট সৃষ্টির প্রতিযোগিতা নয়। সহনীয়, সুশৃংখল, সুমধুর আজানের আওয়াজ নামাজিদের কানে পৌঁছে দেয়ার জন্য আজানকে বলা হয়েছে, আদ দাওয়াতু আত তাম্মাহ। আর পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ, তাকবীর, কিরাত, তাসবীহ, জিকির ও মুনাজাত তো মসজিদের ভেতরকার আমল। এসবই আজানের মাইকে উচ্চস্বরে জনপদে প্রচার করা ইসলামী বিধান, সুন্নত ও ঐতিহ্যের খেলাপ। মনের আবেগ, নির্বুদ্ধিতা, শরীয়তের সৌন্দর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, ধর্মের নামে অযোগ্য লোকেদের হঠকারিতা থেকে ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ বিধানকে রক্ষা করাই প্রকৃত আলেমদের কাজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন