রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০২ রবিউল সানী ১৪৪৬ হিজরী

সম্পাদকীয়

অজ্ঞতা অনেক সময় সত্যকে আড়াল করে

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০২১, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল কয়টি? এ প্রশ্নের জবাবে সবাই এক বাক্যে বলবেন: দু’টি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ দু’টি দলের মধ্যে সম্পর্ক কেমন? এ প্রশ্নের জবাবেও স্বাভাবিক উত্তর হবে: ভালো না। কারণ? কারণ এ দু’টি দল পরস্পরের প্রতিদ্ব›দ্বী। একটি দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে আরেকটি দল থাকে বিরোধী শিবিরে। সুতরাং তাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই তারা সব সময় পরস্পরবিরোধী থাকতে বাধ্য।

এ তো গেল সহজ স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু তারা আসলেই কি পরস্পরবিরোধী? তাদের অতীত ইতিহাস কি তা বলে? দুই দলের অতীত ইতিহাস কিন্তু একরকম নয়। সমান দীর্ঘও নয়। আওয়ামী লীগকে বলা হয়ে থাকে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের জন্ম হয় পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে। যে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয় তার নাম ছিল: পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন। সে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সম্মেলনে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন আমি ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ এর সাথে জড়িত।

সম্মেলন শেষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, আতাউর রহমান খান প্রমুখকে সহ-সভাপতি, ইয়ার মুহম্মাদ খানকে কোষাধ্যক্ষ, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।

অনেকে মনে করেন শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। সে ধারণা সঠিক নয়। তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগে দু’টি উপদল ছিল। একটি আকরাম খাঁ-খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন, আরেকটি সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম নেতৃত্বাধীন। বর্ণিত কর্মী সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিল শেষোক্ত গ্রুপ। শেখ মুজিবুর রাহমান ছিলেন এই গ্রুপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তবে তিনি কারারুদ্ধ থাকায় সম্মেলনে যোগদান করতে পারেননি। তবে সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপে তার গুরুত্ব থাকায় তাকে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।

এর মধ্যে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের ‘অপরাধে’ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক কারারুদ্ধ হন। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে সুযোগ গ্রহণ করতে না পারায় কারারুদ্ধ শেখ মুজিবকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মুক্তি দেয়া হয়। দীর্ঘদিন পর শামসুল হক যখন মুক্তি পান, তখন দেখা যায় তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত। তার এই মানসিক রোগের মূলে সরকারের বা অন্য কারো প্রকৃত কী ভূমিকা ছিল, সে কথা অদ্যাবধি অজানাই রয়ে গেছে। সে সময় শামসুল হক এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, অনেকে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী মনে করতেন।

মানসিক রোগে আক্রান্ত শামসুল হককে প্রায়ই দেখা যেত তিনি পূর্ব পাকিস্তানের দাবি দাওয়া জানাতে পাকিস্তানের রাজধানী করাচী যেতে হবে বলে অর্থ সাহায্য চাইছেন। এক হাজার টাকা চাইলেও ২০০ টাকা পেলেই তা গ্রহণ করতেন। এরপর একদিন দেখা গেল টাঙ্গাইলের কাছে যমুনা নদীতে এক পরিত্যক্ত নৌকায় তার লাশ ভাসছে। স্থানীয় লোকেরা তার লাশ নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেন। তবে এটা দুঃখজনক যে, অদ্যাবধি তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হয়নি।

তিনি শুধু বাংলাদেশের একজন প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, বরং একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি এবং লেখকও ছিলেন। তার রচিত পুস্তক থেকে আমরা ইসলামী আদর্শের বৈপ্লবিক রূপ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় তিনি প্রায়ই লিখতেন। আমরা শামসুল হকের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি পরম দয়াময় আল্লাহতায়ালার কাছে।

এবার ফিরে যাই শুরুর প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘোর পরস্পরবিরোধী বলে বিবেচিত হলেও এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, যে দুই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে দুটি দল গড়ে উঠেছে তারা পরস্পর ছিলেন পরস্পরের প্রতি আস্থাশীল। শুধুমাত্র অতীত সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বর্তমানে দুটি দলের কর্মীরা পরস্পর বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে।

এখানে আমরা কেন এরকম ধারণা পোষণ করি, তার কিছু বাস্তব কারণ উল্লেখ করতে চাই। সবাই জানেন, পাকিস্তান আমলে বাঙালি অবাঙালি সৈনিকদের মধ্যে প্রচুর দ্বন্দ্ব ছিল। অবাঙালি সৈনিকদের একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল, বাঙালিরা অসামরিক জাতি। এ ধারণা ভেঙে দেয়ার মূলে জিয়াউর রহমানের বিরাট অবদান ছিল। পাকিস্তান আর্মিতে কাজ করাকালে খেমকারান সেক্টরে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় যে বীরত্ব ও রণনৈপুণ্য তিনি প্রদর্শন করেন, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহর লাহোর রক্ষা পায়। সে সময় বাঙালিরা যে অসামরিক জাতি সে ধারণা যে ভুল পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে লেখালেখি হয়। জিয়া পাকিস্তানি সৈনিকদের এ ধারণা যে ভুল তা দ্বিতীয় বার প্রমাণ করেন ঊনিশশ’ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি এক সফল সেক্টর কমান্ডার হিসাবে অসাধারণ যোগ্যতা ও পারঙ্গমতার পরিচয় দেন।

পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান আর্মির বাঙালি ও অবাঙালি সৈনিকদের মধ্যে একটা বিষয়ে প্রায়ই বিতর্ক হতো। পাকিস্তান আর্মির সকল বাঙালি সদস্যই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভক্ত। পক্ষান্তরে অবাঙালি সদস্যরা ছিল তার ঘোর বিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই এরকম দ্ব›েদ্ব জড়িত হওয়াটা ছিল তাদের প্রায় নিয়মিত ব্যাপার। একবার জিয়াউর রহমান এরকম বিতর্কে জড়িত হয়ে এক অবাঙালি সদস্যের ওপর শারীরিকভাবে চড়াও হয়ে তাকে আহত করেন। অপর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ছিলেন জিয়ার প্রতি অত্যন্ত ¯েœহশীল। যে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান আমলে মেজরের ওপরে উঠতে পারেননি, তাকে বাংলাদেশ আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেজর থেকে একের পর এক প্রমোশন দেন। এই ছিল যেখানে দু’জনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সেখানে গায়ে পড়ে দু’জনের মধ্যে শত্রুতা আবিষ্কার করা যে কত বড় অন্যায়, তা কল্পনা করতেও আমাদের কষ্ট লাগে।

হ্যাঁ, তবে দু’জনের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা যায় না, তা নয়। তবে তা ছিল রাজনৈতিক দৃষ্টভঙ্গি ও আদর্শ নিয়ে। যে কারণে ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিহ্নিত হয়ে আছেন এক দলীয় বাকশালী শাসনের প্রবর্তক হিসেবে। অন্য পক্ষে জিয়াউর রহমান চিহ্নিত হয়ে আছেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবে। এ এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী ঘটনা। যিনি ব্রিটিশ আমল থেকে সবসময় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রাম করে এসেছেন, তিনি যখন তার জীবনের চূড়ান্ত স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একটি মাত্র সরকারি দল রেখে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করলেন। এর চাইতে অবিশ্বাস্য ঘটনা কী হতে পারে?

এটা যে গণতন্ত্রপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর নিজের সারা জীবনের রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিরোধী ছিল, তা বুঝয়ে দিতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে এই অসম্ভব কাজটা কে করিয়ে নেন? বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহ। কমরেড মনি সিংহ ছিলেন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনের অন্ধভক্ত। তিনি তার এই কাজের সপক্ষে এক পর্যালোচনায় বলেন, বাকশাল কোনো একাঙ্ক নাটক ছিল না। ছিল বহু অঙ্কের নাটক। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের পর ক্রমান্বয়ে যদি কমিউনিস্ট পার্টির এক দলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেত তাহলে বাকশালী শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত সুফল লাভ করা যেতো। কমরেড মনি সিংহের এই কথা থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায়, বাকশালী একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মতো অগণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের জন্য মূলত দায়ী বঙ্গবন্ধু নন, দায়ী মনি সিংহ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন