রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০২ রবিউল সানী ১৪৪৬ হিজরী

সম্পাদকীয়

সত্যের সঙ্গে যুদ্ধে মিথ্যা কেন এগিয়ে?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

প্রতিটি জাতির একটি ট্রাডিশন, ঐতিহ্য বা পরম্পরা থাকে। মন, মেজাজ, অনুভ‚তি, একজনের প্রতি অন্যজনের মমত্ববোধ বা কর্তব্যবোধ, নিষ্ঠা, জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ, মিথ্যার সাথে আপসকামিতা বা মিথ্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতিসহ আনুষঙ্গিক নিজস্ব নিয়মানুবর্তিতা থেকেই শুরু হয় একটি জাতির সংস্কৃতির গোড়াপত্তন। এ গোড়াপত্তন ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে কোথাও কোথাও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে, কোথাও কোথাও থমকে গেছে বা কোথাও কোথাও গতি পেয়ে অনেক উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্ষয়িষ্ণু রোগে ধ্বংস হয়েছে। একসময় বলা হতো, ব্রিটিশ রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। এখন ব্রিটিশ রাজ্য এখনো সে অবস্থানেই। তাদের ট্রাডিশন পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশ একটি দখলদার জাতি, কিন্তু নিজেদের একটি সভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, যাদেরকে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই অনুকরণ করে, বিশেষ করে ব্রিটিশের লিগ্যাল সিস্টেম পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত।

বহুজাতির সংমিশ্রণে বাঙালি একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের ৬(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকরা বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ ভ‚তত্ত¡বিদদের মতে, বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্টি হওয়া ভূখÐই বাংলাদেশ। ভ‚তত্ত¡বিদরা এখন আশঙ্কাও করছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে। অবশ্য ভিন্ন মতও আছে। কারণ, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় নতুন করে এত বড় চর জাগছে, যা একটি বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে না। যদি তাই হয় তবে বাংলাদেশের খাদ্যাভাব তো থাকবেই না, বরং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হবার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা আশা করা যেতে পারে। বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে চিন্তা করার পাশাপাশি এ জাতিকে গুণগতভাবে উচ্চ শিখরে পৌঁছার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। বাঙালি জাতির যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়, অন্যদিকে জাতির সাথে বেঈমানির ইতিহাসও কম নয়। এই জাতির ইতিহাসে সিরাজদ্দৌলার জন্ম হয়েছে, মীরজাফরের দৃষ্টান্তও অনেক রয়েছে। বর্তমানে সত্যের সাথে যুদ্ধ করে মিথ্যা এগিয়ে আছে। এটিই এখন বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

বিভিন্ন সংগঠনের স্মরণিকা প্রকাশ করার জন্য বিশেষজনের ‘বাণী’ আনতে গেলে, তাদের অধিকাংশই বলেন, ‘বাণীটি লিখে নিয়ে এসো’। আজানগাছী দরবার শরিফের স্মরণিকা প্রকাশ করার জন্য একবার আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে। এতে রাষ্ট্রের শীর্ষ পদাধিকারীদের বাণী ছাপা হয়, যা উদ্যোক্তাদের লিখে দিতে হয়, দায়িত্বশীল স্বনামধন্য ব্যক্তিরা শুধু স্বাক্ষর করেন। আমি বিআরটিসির চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ২০০৪ সালে ৪৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় বিশিষ্টজনদের বাণী ছিল, যার সবই বিআরটিসি থেকে লিখে দিতে হয়। ফলে স্বনামধন্য ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কী চিন্তাভাবনা করেন এবং জাতির প্রতি তাদের দিকনির্দেশনা কী, সে সম্পর্কে জনগণ ও উদ্যোক্তা সংগঠন কিছুই জানতে পারেনি। স্মরণিকাতে বাণী প্রকাশে বিআরটিসি বা স্বনামধন্য ব্যক্তিরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন বলে আমি মন্তব্য করব না। তবে এটুকু বলতে চাই, এটি মিথ্যার বহিঃপ্রকাশ, নাকি দায়িত্ব যথাযথ পালনে অনীহা, তা আমার বোধগম্য নয়।

সত্যের ওপর অধিষ্ঠিত থেকে নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করার শপথ নিয়ে সাংবিধানিক পদ যারা দখল করে আছেন তারা শুধু নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছেন। বিনিময়ে শাসকগোষ্ঠির আজ্ঞাবহ হয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরসহ সুখে শান্তিতে জীবন কাটানোর নিশ্চিয়তা আদায় করে নিচ্ছেন। এটা জাতির জন্য কম ট্র্যাজেডি নয়। দায়িত্বশীল বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসে মিথ্যা বলা বা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে প্রবণতা বা সংস্কৃতি শুরু হয়েছে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ দেশপ্রেমের পরিবর্তে চলছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেদের অধিষ্ঠিত রাখার প্রবণতা। একটি মিথ্যাকে প্রমাণ করার জন্য ১০টি মিথ্যা কথা বলা হয়, তারপরও মানুষ মিথ্যা বলে, অহরহ বলে এবং যেখানে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই সেখানেও বলে। ফলে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা বা কোনটি অর্ধ মিথ্যা তাও নির্ণয় বা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রায় ২০ বছর আগে একটি আলোচনায় শুনেছিলাম যে, জাপানে গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত পতিতারা তাদের সাথে চুক্তিভিত্তিক মজুরি গ্রহণ করে, কিন্তু বকশিস নেয় না। অন্যদিকে বাংলাদেশে ঘুষ বা বকশিস ছাড়া একটি টেবিলের ফাইল অন্য টেবিলে যায় না। ইনকাম ট্যাক্স অফিসের লোকেরা এর নাম দিয়েছে ‘টেবিল মানি’। ‘টেবিল মানি’ এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে, ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও চোখে পড়ার মতো নয়। যারা টেবিল মানি ছাড়া কাজ করে না তাদের মধ্যে অনেকেই বছর বছর হজ করছে।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক বলেছেন যে, ‘সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত কক্ষপথে ভ্রাম্যমাণ। তারকা ও গাছপালা তাকেই (আল্লাহকে) সেজদারত’। অর্থাৎ তারা আল্লাহর দেয়া নিয়মেই সমর্পিত এবং আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে (সূত্র: সূরা আর রহমান আয়াত ৫/৬)। মানুষকেও সৃষ্টি করা হয়েছে দায়িত্ব পালনের জন্য এবং সৃষ্টির সময় এ দায়িত্ব পালনের জন্য মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি বিবেকই জীবন ধারণের একমাত্র চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে খাদ্যে যে পরিমাণ ভেজাল দেয়া হয়, সে পরিমাণ ভেজাল দেয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে নেই। আমাদের দেশে মানুষের জটিল রোগ হওয়ার অন্যতম কারণ ভেজাল খাদ্য গ্রহণ।

আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার আগে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না বলে শপথগ্রহণ করার পরও মানুষজন অহরহ মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া নৈতিকতাবিরোধী বা জনগণের কাছে হেয় হতে হয়, এ কথা যেন মানুষ ভুলে গেছে। সরকারি আমলারা জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মিথ্যা কথা বলে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা জনগণকে ধোঁকা দিতে দিতে আস্থাহীনতায় পড়েছেন। জনগণের আস্থা বনাম ক্ষমতার দাপট এখন সমান্তরাল গতিতে চলছে না, বরং বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যা মামলায় ২০ জন ছাত্রের ফাঁসি ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। যাদের সাজা হয়েছে তারাও মেধাবী ছাত্র। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একজন ছাত্রকে বুয়েটে ভর্তি হতে হয়। একজন অভিভাবককে তার সন্তানকে বুয়েট পর্যন্ত পৌঁছাতে জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করতে হয়। আবরার হত্যায় শাস্তি হয়েছে সন্তুষ্ট হয়েছি। কিন্তু আনন্দিত হইনি এ কারণে যে, দেশের ২৫টি পরিবার থেকে ২৫ জন সম্ভাবনাময় প্রকৌশলী ঝরে গেল। রাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তি প্রকট আকার ধারণ করায় ছাত্র-শিক্ষকরা এখন লেখাপড়া বা গবেষণায় আত্মনিয়োগ করার পরিবর্তে নেতা বা নেত্রীদের খুশি রাখার কাজে বেশি আত্মনিয়োগ করে বিধায় শিক্ষাঙ্গনে খুন খারাবির গোড়াপত্তন হয়েছে।

সৃষ্টিকর্তা ওয়াদা বা প্রতিশ্রæতি রক্ষা করার জন্য শুধু তাগিদ নয়, বরং নির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষ প্রতিশ্রæতি রক্ষা করবে এটাও নৈতিকতা। কিন্তু এখন অনেকে প্রতিশ্রæতি বা ওয়াদা করার সময়ই চিন্তা করে কীভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করা যায়। কাগজ-কলমে লিখিত দলিল করার পরও দলিলকে অস্বীকার করে। অন্যদিকে আলোচনায় শর্ত দেয়া হয়নি, কিন্তু কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে দলিলের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করে। মিথ্যা যে নৈতিকতা পরিপন্থী একটি বিষয়, তা অনেকে উপলব্ধি করে না, বরং এটিকে কৌশল মনে করে নিজেদের বুদ্ধিমান বা ইনটেলেকচুয়াল মনে করে।
শুধু দালানকোঠা বা অবকাঠামোর উন্নয়নই জাতির উন্নয়ন নয়। অবকাঠামো উন্নয়নের ফল একটি গোষ্ঠি, যারা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকে, তারাই ভোগ করে। কিন্তু আমজনতা ভোগ করতে পারে না। সার্বিকভাবে নৈতিকতার প্রশ্নে একটি জাতির যদি গুণগত উন্নয়ন হয় তবে সেই জাতি দু’বেলা খেয়ে পরে সম্মানজনক সহ-অবস্থানে সম-অধিকারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত বসবাসযোগ্য একটি দেশ গড়ে তুলতে পারে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২২ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:১৫ পিএম says : 0
If our country ruled by Quran then you do not need to waste time write this article.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন