বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিশেষজ্ঞদের মতে- ঢাকার পানিবদ্ধতার নেপথ্যে

সমন্বিত ও জনসম্পৃক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে পানিবদ্ধতা দূর করা সম্ভব : স্থপতি ইকবাল হাবিব

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

রাজধানী ঢাকার পানিবদ্ধতার চিত্র ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সামান্য বৃষ্টিপাতেই এই শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তলিয়ে যায়। বর্ষায় পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ভয়াবহ। টানা কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় প্রায় পুরো শহর। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পক্ষ থেকে হাঁকডাক দেওয়া হলেও কার্যত সমস্যার সমাধান হয় না।
ঢাকার পানিবদ্ধতা নিরসনের নামে প্রতিবছর ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। নগর বিশেষজ্ঞরা ঢাকার পানিবদ্ধতার জন্য অনেক কারণের মধ্যে প্রধানত তিনটি কারণ চিহ্নিত করছেন। এ কারণগুলো হলো, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পলিথিন বন্ধ না হওয়া ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব এবং ঢাকার চারপাশের নদীগুলো ভরাট হওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের সবচেয়ে সমন্বয়হীন অবহেলিত একটি খাত হচ্ছে পানিবদ্ধতা নিরসন। ছয়টি সংস্থা ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পানিবদ্ধতা নিরসনের কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সংস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপায়। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। পানিবদ্ধতার জন্য নগরবাসীর দুর্ভোগ বেড়েই চলছে।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই মহানগরীতে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস। এই শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে শহরের বেশিরভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। নগরীতে যতগুলো প্রাকৃতিক খাল আছে তার অনেকাংশ দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রæত নিষ্কাশন হতে পারছে না। নালা ও ডোবা বৃষ্টির পানির আধার হিসেবে কাজ করে থাকে। অবৈধভাবে অনেক ডোবা-নালা ভরে সেখানে ঘরবাড়ি, আবাসন প্রকল্প, অফিস ভবন অথবা শপিংমল করা হয়েছে।

ঢাকা অতিদ্রæত নগরায়ণের ফলে বৃষ্টির পানির সব অংশই নর্দমা ও প্রাকৃতিক খালের মধ্যে যাচ্ছে এবং মাটির নিচে তেমন পানির প্রবাহ যেতে পারছে না। কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে ময়লা-আবর্জনায় নর্দমা ও প্রাকৃতিক খাল ভরাট হয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহের ক্ষমতা অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্নয়হীনতা এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার পানিবদ্ধতা দূর করতে হলে সামগ্রিকভাবে একটি সমন্বিত ও জনসম্পৃক্ত প্রকল্প প্রয়োজন। আমরা বার বার এটি বলে আসছি। এখনো সেটি হচ্ছে না। আমাদের অনেক সুপারিশের পর ঢাকার ৬৪টি খালের মধ্যে ২৬টি খাল ওয়াসার কাছ থেকে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে খালের সংখ্যা ৪৮টি। এর মধ্যে অনেকগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।

চলতি বছরের জানুয়ারির ১ তারিখ ২৬টি খালের দায়িত্ব পেয়ে সিটি করপোরেশন পরিষ্কার করেছে। এতে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে। জমে যাওয়া পানি অন্তত দু’তিন ঘণ্টার মধ্যে নেমে যাচ্ছে। ঢাকার খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে এর সুফল আরও বেশি পাওয়া যাবে। ঢাকার অনেক খাল এখনো পাউবোÑ রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থার অধীনে রয়েছে। এগুলো সব একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে আনতে হবে।

তিনি বলেন, এ ছাড়া ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহারে সর্বনাশ হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। পলিথিনের উৎপাদন-বিপণন ও ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রতি বছরই বিকল হবে এবং পানিবদ্ধতার দুর্ভোগ কমবে না। তিনি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের ফলে ছোট ছোট ডোবা-নালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবুজ ভ‚মির পরিমাণ অনেক কমে যাচ্ছে। এর ফলে মাটির নিচে যে পরিমাণ পানি যাওয়ার কথা তার অর্ধেকও এখন যেতে পারছে না।
রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো দখলে-দূষণে ভরাট হচ্ছে। নদীগুলোতে এখন আর প্রাণ নেই। পানির প্রবাহ নেই। ফলে রাজধানী থেকে বৃষ্টির পানি দ্রæত নদীতে নামতে পারে না। তাই ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকেও পুনঃখনন করে তাতে পানির প্রবাহ আনতে হবে, নদীর জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে।

দেশের অন্য সব সিটি করপোরেশন এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট করপোরেশন কর্তৃপক্ষের। শুধু ঢাকায় এ দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ ছয়টি সংস্থা পালন করে। তবু জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হয়নি। দু’তিনদিন আগেও মাত্র ঘণ্টা খানের বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের অনেক এলাকা ডুবে যায়। এ জন্য সিটি করপোরেশন ঢাকা ওয়াসা বা পাউবোকে দোষারোপ করে। আবার অন্যসংস্থাগুলো বলে পানিবদ্ধতা নিরসনের দায় সিটি করপোরেশনের। কারণ, পানিবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনও বছর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে দোষারোপ না করে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে যার যে দায়িত্ব, তাকে ওই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে সমন্বিতভাবে এ বিষয়টি নিরসনে একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। আর তাতে অবশ্যই জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কেননা জনগণকে সম্পৃক্ত ও তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া এ বিষয়ে সফল হওয়া সম্ভব নয়। খালে ময়লা ফেলা নিষেধ। তা অমান্য করে ময়লা ফেলা হচ্ছে খালে। পরিষ্কার না করায় খালটি দিন দিন ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। সিটি করপোরেশন বা ওয়াসা প্রতিবছরই তা পরিষ্কার করছে। তারপর আবারও ময়লা-আবর্জনা ফেলে খাল ভরাট করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করতে পারলে এবং তাদের খাল রক্ষণাবেক্ষণে সম্পৃক্ত করতে পারলে দ্রæত সুফল পাওয়া যাবে। খাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনে জনগণকে প্রণোদনা দিতে হবে।

ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু এগুলো ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশন এখনো সফল হতে পারেনি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকায় যে গৃহস্থালি বর্জ্য হয় তার বেশিরভাগই পলিথিন। মোট বর্জ্যের ৬০ শতাংশের ব্যবস্থাপনা করতে পারে সিটি করপোরেশন। বাকি ৪০ শতাংশ খাল বা নালায় পড়ে। এতে খাল ও নালার পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে পানিবদ্ধতা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থা (সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, পাউবো) মিলে ঢাকার পানিবদ্ধতা নিরসন প্রক্রিয়াকে একটি জটিল অবস্থায় নিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত চার-পাঁচটি মহাপরিকল্পনা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় ঢাকার পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব এককভাবে সিটি করপোরেশনকে দিতে হবে। পাশাপাশি ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধিদের আরও শক্তিশালী করতে হবে, তাদের ক্ষমতা দিতে হবে। এ ছাড়া সমন্বিত প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। পলিথিনের ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। চারপাশের নদীগুলোকে প্রবাহমান করতে হবে। তা না হলে বছর বছর শত শত কোটি টাকা শুধু খরচ হবে, কিন্তু সুফল পাওয়া যাবে না।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন