হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) তার ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’ গ্রন্থে একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, তিনি লিখেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-এর অনেক বড় একটি আপেলের বাগান ছিল। তিনি ছিলেন চরম মুক্তমনা। তার না ছিল ইলমের সাথে কোনো সম্পর্ক, আর না দীনের সাথে। মদের আড্ডা ও গান-বাজনার মধ্যেই কেটে যেত তার দিন-রাত। একবার আপেলের মৌসুমে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজেদের বাগানে চলে গেলেন। উদ্দেশ্য আপেল খাওয়া ও আমোদ-প্রমোদ করা। তাই তিনি সেখানে দিন কাটাতে লাগলেন। এ দিকে বাগানে বন্ধু-বান্ধবদের জন্য গান বাজনার বিরাট আয়োজন করা হলো। পাশাপাশি মদ পানের ব্যবস্থাও রাখা হলো। উল্লেখ্য, তিনি কিছু বাদ্যযন্ত্র নিপুনভাবে বাজাতে জানতেন এবং একজন সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন।
এ দিকে মদের নেশা আর বাদ্যের তালে তিনি এক সময় নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েন। কিছুক্ষণ পর জাগ্রত হয়ে দেখেন তার বাদ্যযন্ত্রটি তার কোলে পড়ে আছে। তখন তিনি পুনরায় বাদ্য যন্ত্র বাজাতে চাইলেন। কিন্তু ঐশী ইশারায় যন্ত্রটি কিছুতেই বাজলো না। কোনো আওয়াজই আসলো না। তখন তিনি সেটি ঠিক করে পুনরায় বাজাতে চাইলেন। কিন্তু এতেও কাজ হলো না।
ব্যর্থ হয়ে আবার ঠিকঠাক করলেন এবং বাজাতে চাইলেন। যন্ত্রটি তখনো বাজলো না কিন্তু এবার সে যন্ত্র থেকে সঙ্গীতের আওয়াজের পরিবর্তে কোরআনে কারীমের একটি আয়াতের সুর ধ্বনিত হতে লাগল। যার অর্থ, এখনও কি ঈমানদারদের জন্য সে সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তরগুলো নম্র হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তাআলা যে চির সত্য বাণী অবতীর্ণ করেছেন, তার জন্য তাদের অন্তরসমূহ বিনয়ী হবে?
এক বর্ণনায় দেখা যায় যে, এই আওয়াজ বাদ্যযন্ত্র হতে এসেছিল। অবশ্য অন্য এক রেওয়ায়েতে দেখা যায়, তিনি যে স্থানে বসা ছিলেন তার নিকটের গাছে বসা একটি পাখির মুখ থেকে এ সুর বেরিয়ে ছিল। কিন্তু কথা হলো এই ধ্বনি যেভাবেই আসুক না কেন এর পেছনে যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হেদায়তের ফায়সালা কার্যকর ছিল; তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।
ঐশী সুরের এ অনুরণন আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-এর অন্তরে রেখাপাত করল। হৃদয়ের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে হঠাৎ বিজ্লী চমকে উঠল। তখন তিনি বলে উঠলেন, হায়! এ পর্যন্ত আমি আমার জীবনের মূল্যবান সময়গুলোকে কোনো কাজে ব্যয় করেছি। এরপর বললেন, হে প্রভু! আর দেরি নয়। এক্ষুনি আমি আমার সকল ব্যস্ততা এড়িয়ে তোমার দিকে মনোনিবেশ করছি। (বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন : পৃ. ১৫৫)।
সেখান থেকে ফিরে এসে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) জ্ঞানার্জনে এমনভাবে ব্যাপৃত হন যে, পরবর্তীতে তিনি একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, বুজুর্গ এবং পরবর্তী জাতির জন্য একজন রাহবার হয়ে কিয়ামত পর্যন্ত অমর হয়ে আছেন।
হযরত ইসমাঈল ইবনে আব্বাস তাঁর সম্পর্কে বলেন, আমি পৃথিবীর বুকে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-এর মতো কোনো লোক দেখিনি এবং তাঁর মতো উত্তম চরিত্রের অধিকারী কেউ বর্তমান জগতে বলে শুনিনি। বড় বড় মাশায়েখেগণও তাঁর সাহচর্যে থেকে ধন্য হয়েছেন।
তিনি তাঁর জীবনকে তিন ভাগে বিভক্ত করে অতিবাহিত করতেন। তিনি এক বৎসর হজ্ব করতেন। দ্বিতীয় বৎসর জিহাদের ময়দানে কাটাতেন এবং তৃতীয় বৎসর ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় তিনি যে লাভ করতেন তা গরিব মিসকিনদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।
তিনি একবার এক স্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন, লোকেরা তাঁকে আসতে দেখে এক অন্ধ ব্যক্তিকে বলল, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক আসছেন, তোমার কিছু চাওয়ার থাকে তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে চেয়ে নাও। তাকে দিয়ে দোয়া করিয়ে নাও। যখন তিনি অন্ধের খুব কাছাকাছি এলেন, তখন অন্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁর নিকট দোয়ার দরখাস্ত করল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক তার জন্য দুআ করলেন। সাথে সাথে অন্ধ লোকটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। এই মহামনীষী ১৮১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন