[দৈনিক ইনকিলাবের যশোরের ব্যুরো চিফ ও বিশেষ সংবাদদাতা মিজানুর রহমান তোতা আর আমাদের মাঝে নেই। গতকাল তিনি যশোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো। এর আগে গত ৪ জুন ২০২১ দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়।]
প্রাচীন জনপদ যশোর। এর শিল্প, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল এই ৪টি জেলা নিয়ে বৃহত্তর জেলা যশোর। প্রাচীনকাল থেকেই এই জনপদ ঐতিহ্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। টলেমির মানচিত্রে এই ভুখন্ডের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রাচীন গঙ্গারিডি রাজ্যের অংশ, পাল ও সেন আমলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপদ যশোর। যশোরের মানচিত্রে রদবদল ঘটেছে বারবার। সেটিও একটি ইতিহাস।
সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোর-খুলনার ইতিহাসে উল্লেখিত হয়েছে, বিস্তৃত এলাকা নিয়ে ছিল যশোর রাজ্য। খুলনার দক্ষিণভাগ, ২৪ পরগনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে ছিল যশোর। যশোরের জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৭৬৯ সালে। ১৭৮১ সালে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য প্রথমে একজন কালেক্টর পরে শান্তিরক্ষার জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট পাঠানো হয়। তার অফিস ছিল যশোর সদর দপ্তরের দুই মাইল দূরে মুড়লীতে। মুড়লী কাচারি ১৭৯০ সালে সরিয়ে নেওয়া হয় সাহেবগঞ্জে। এখানে বলা দরকার, নীলবিদ্রোহ যখন ব্যাপক রূপ পায় তখন যশোর জেলাকে খুলনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল ও যশোর এই ক’টি মহাকুমায় বিভক্ত করা হয় প্রশাসনিক কারণে। কয়েক বছর পর ১৮৮২ সালে যশোর জেলা থেকে আলাদা করে খুলনা জেলা গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় যশোর জেলার বনগাঁ ও গাইঘাটাকে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
যশোর-খুলনার ইতিহাসে উল্লেখিত আছে, মোগল ও পাঠানের পর ১৫৭৪ সালে যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল যশোর। যশোর রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে পদ্মা, কুষ্টিয়া, পূর্বে মধুমতি অর্থাৎ ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা এবং পশ্চিমে ভাগিরথি নদী। বৃহত্তর যশোর জেলা বাংলাদেশের মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চলের অংশবিশেষ। পদ্মা ও তার প্রধান শাখা মাথাভাঙ্গা ও গড়াই নদীর পললে যশোরের মৃত্তিকা গঠিত। জেলার ভূপৃষ্ঠে কাদা, পলি ও শুষ্ক বালি বিদ্যমান। ১৯৭০ সালে মৃত্তিকা জরিপে এ জেলায় ৩৮ রকমের মাটি পাওয়া যায়। এর মধ্যে বেলে, দো-আঁশ, এটেল, হালকা বাদামী, চুনযুক্ত গাঢ় ধূসর, পীট বা দৈবমাটি ও চুনবিহীন বাদামী মাটি।
যশোর জেলার ইতিহাস অনেক লম্বা। অল্পকথায় বলে শেষ করা যাবে না। পীর খান জাহান আলীসহ বারোজন আউলিয়া যশোরের মুড়লীতে ইসলাম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। যশোর শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদ। এই নদকে ঘিরেই গড়ে ওঠে যশোর শহর। যশোরের বর্তমান সুনাম ফুলের রাজধানী, ভেজিটেবল জোন, খেজুর গুড়, মাছের রেণুপোনার জন্য। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর দেশের তৃতীয় বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয় যশোরকে। এখান থেকে বর্তমানে ১২টি দৈনিক পত্রিকা বের হয়। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোল। আছে বৃহত্তম বিমান ঘাঁটি। সেনানিবাসও বড়। দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোর। বৃহত্তম আইটি পার্ক (শেখ হাসিনা আইটি পার্ক) যশোরে। এশিয়ার মহাদেশের বৃহত্তম বীজবর্ধন খামার যশোরের ঝিনাইদহে। তাল, তমাল, খেজুর বীথির বৃহত্তর যশোর বহু গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ।
যশোর অঞ্চলের মাটিতে জন্মেছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। মহাকবি মাইকেল মধূসুদন দত্ত, কর্মবীর মুন্সী মেহেরুল্লাহ, জ্যোতিষ্কবিজ্ঞানী রাধা গোবিন্দ চন্দ্র, মরমি কবি লালন শাহ, কবি পাগলা কানাই, কবি ফররুখ আহমেদ, কবি গোলাম মোস্তফা, মনোজ বসু ও ধীরাজ ভট্টাচার্য, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহসহ বহু কবি-সাহিত্যিকের জন্ম এই ভূখন্ডে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিচরণ ছিল বৃহত্তর যশোরে। দক্ষিণডিহিতে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি ছিল। তিনি অনেকবার যাতায়াত করেছেন এই এলাকায়। চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় কয়েকবার এসেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলার বিখ্যাত গণিতবিদ অধ্যাপক কালীপদ বসু এবং উপমহাদেশে ব্রিটিশ দখলদারিত্ব বিরোধী আন্দোলনে পথিকৃতদের অন্যতম বাঘা যতীনের জন্ম ঝিনাইদহে। বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা মনোয়ার, প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর, আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী সংগীতজ্ঞ রবীশংকর, সাহিত্যিক নীহার রঞ্জন গুপ্ত, চারণ কবিয়ালসম্রাট বিজয় সরকারের জন্ম নড়াইলে।
বাংলা একাডেমি ও প্রফেসর আমিরুল আলম খানের প্রকাশনা সূত্রে জানা যায়, যশোরের অন্যতম কৃতী সন্তানের নাম হরিনারায়ণ ঘোষ। যশোর আদালতে নকলনবিশ ও পরে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তার পুত্র শিশিরকুমার ঘোষ। জন্মেছিলেন যশোরের ঝিকরগাছার পলুয়া-মাগুরা গ্রামে। গ্রামটি অবস্থিত কপোতাক্ষ নদপাড়ে। এই গ্রামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি বাজার, মা অমৃতময়ীর নামে নাম রাখেন অমৃতবাজার, আস্তে আস্তে ওই নামেই গ্রামটি পরিচিতি লাভ করে, এখনও সেই নামে পরিচিত গ্রামটি।
নীলচাষের বিরুদ্ধে শিশিরকুমার ঘোষ ছিলেন অন্যতম সংগঠক, তিনি সংগঠিত করতে থাকেন নির্যাতিত নীলচাষিদের। একপর্যায়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে যশোরে। নীলবিদ্রোহ আতঙ্কিত করে তোলে ইংরেজ সরকারকে। শিশিরকুমার ঘোষ নীলকরদের অত্যাচার এবং চাষিদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা লিখতেন কলকাতার প্রভাবশালী দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়। পত্রিকাটিতে নীলচাষিদের পক্ষাবলম্বন করে লিখে প্রাণ জুড়ায়নি তাঁর। তাই নিজে একটি পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যান্য ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে কলকাতা থেকে তিন শ’ টাকায় কিনে আনেন একটা কাঠের মুদ্রণযন্ত্র। নিজ গ্রাম অমৃতবাজার থেকে দাদা বসন্তকুমারের সম্পাদনায় ১৮৬২ সালে প্রকাশ করেন পাক্ষিক অমৃত প্রবাহিনী, এটি এ অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্র। পরে শিশিরকুমার ঘোষ শিক্ষকতা শুরু করেন। বেশি দিন ওই পেশায় থাকতে পারেননি। সাংবাদিকতার টানে আবার ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরোনো সেই প্রেস থেকে শিশিরকুমার ঘোষ নতুন উদ্যোমে প্রকাশ শুরু করেন সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকার প্রকাশনা। বছর খানেক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায়। তারপর ইংরেজি-বাংলা দ্বিভাষিক সংবাদপত্রে রূপান্তরিত করেন তিনি। ১৮৭১ সালে স্বপরিবারে চলে যান কলকাতায় এবং সেখান থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা।
যশোরের আরেক নক্ষত্র যদুনাথ মজুদার ১৮৮১ সালে এম. এ পরীক্ষায় ইংরেজিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও তিনি সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, ফার্সি ও গুর্খাসহ বিভিন্ন ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর প্রণীত গ্রন্থের সংখ্যা ২১। কিছুকাল সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করার পর তিনি ইউনাইটেড ইন্ডিয়া নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। পরে ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদকের পদ নিয়ে লাহোর গমন করেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর মধ্যে নানাদিক দিয়ে যশোরের খ্যাতি রয়েছে। স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার, অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা, আন্দোলন সংগ্রামের পীঠস্থান এই যশোর। পাকিস্তান আমলের সাংবাদিক স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শহীদ হন ঝিনাইদহের আজাদের রিপোর্টার হাবিবুর রহমান। স্বাধীনতার পরে তার দুই পুত্র শেখ মিজানুর রহমান ও শেখ ওয়াসিকুর রহমান সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। যশোরে পাকিস্তান আমলে একজন মহিলা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। তার নাম আয়েশা সরদার। পাক্ষিক পত্রিকাটির নাম ছিল শতদল। তিনি ছিলেন অর্থবিত্তশালী। সমাজের পিছিয়েপড়া মানুষদের পাশে দাঁড়াতেন। সুখী-দুঃখীর সাথী হতেন। করতেন সাহিত্যচর্চা। একই সাথে তিনি অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে থাকতেন সোচ্চার। প্রায় একই সময় যশোর থেকে অহেদ আলী আনছারী এবং লাল মোহাম্মদ পত্রিকা বের করতেন। একপর্যায়ে ওইসব প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। (সংক্ষেপিত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন