শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

অলিম্পিকসে অ্যাথলিটরা নগ্ন হয়ে নামলে কী ঘটতে পারে?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০২১, ৭:৪৫ পিএম

প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পিকসে প্রতিযোগীরা নগ্ন হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন ।


প্রাচীন গ্রিসের একটি গল্প আছে যে ৭২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এক অলিম্পিকসের একটি প্রতিযোগিতায় দৌড়ানোর সময় একজন অ্যাথলিটের কোমরের নেংটি খুলে গিয়েছিল। কিন্তু অর্সিপাস নামে ওই অ্যাথলিট তার লজ্জা ঢাকতে ১৮৫ মিটারের দৌড় বন্ধ করেননি, বরং নগ্ন অবস্থাতেই শেষ অবধি দৌড়িয়ে সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। এর পর থেকেই সেই গল্প বিখ্যাত হয়ে যায়।

প্রাচীন গ্রিসে এক সময় নগ্ন অ্যাথলিটিক প্রতিযোগিতা দারুণ জনপ্রিয় ছিল। অ্যাথলিটরা সেসব প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন গায়ে প্রচুর জলপাইয়ের তেল মেখে - যাতে তাদের দেহের পেশী আরো ফুটে ওঠে। নগ্ন অ্যাথলিটকসকে তখন দেখা হতো দেবতা জিউসের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন হিসেবে। গ্রিকদের কাছে তাদের গ্রিক আত্মপরিচয় এবং সৌজন্যের স্বীকৃতির একটা নিদর্শনে পরিণত হলো এই নগ্নতা। তবে ১৮৯৬ সালে যখন আধুনিক অলিম্পিকসকে পুনরুজ্জীবিত করা হলো, তখন অবশ্য মানুষের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী অনেক পাল্টে গেছে। সেই অলিম্পিকের আয়োজকরা কল্পনাও করেননি, নগ্ন অবস্থায় প্রতিযোগিতার সেই গ্রিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা। তা ছাড়া আধুনিক অ্যাথলিটিক প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়দের পোশাক একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাও পালন করে।

এখন দৌড়বিদরা যে জুতো পরেন তা এমনভাবে তৈরি যে তা তাদের পা হড়কে যাওয়া প্রতিরোধ করতে পারে, এবং রানারদের গতিসঞ্চারে সহায়তা করে। সাঁতারুরা যে পোশাক পরেন - তা তাদের পানি কেটে এগিয়ে যাওয়া আরো সহজ করে দেয়। তা ছাড়া আঁটোসাঁটো পোশাক বাতাসের বাধা কাটাতে সহায়ক হয় - যাকে বলে 'ড্র্যাগ'। এবার টোকিওতে যে অলিম্পিকস হচ্ছে তা নানা দিক থেকে অনন্য, যার এর একটা কারণ অবশ্যই কোভিড-১৯ মহামারিজনিত বিধিনিষেধ। কিন্তু ধরুন, যদি অলিম্পিক আয়োজকরা ভাবতেন যে তারা প্রাচীন গ্রিক অলিম্পিক ঐতিহ্যের সেই নগ্নতাকে ফিরিয়ে আনবেন - তাহলে কী ঘটতে পারে? এটা অবশ্যই বলতে হবে যে, এখন কেউই নগ্ন অলিম্পিক ফিরিয়ে আনার কথা বিবেচনা করছে না।

কিন্তু যেটা ভাবার বিষয় তা হলো, এরকম কিছু হলে অ্যাথলিটিকস প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, লিঙ্গবৈষম্যবাদ এবং আরো অনেক গুরুতর বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতো। কী সেই প্রশ্নগুলো? শুধু লজ্জা নিবারণ নয়, প্রথমেই যেটা মনে আসবে যে নগ্ন অবস্থায় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নামলে অনেক প্রতিযোগীর ক্ষেত্রেই বেকায়দায় পড়ার মত কিছু সমস্যা দেখা দেবে। আধুনিক প্রতিযোগীরা অনেক খেলাতেই তাদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন প্রায়-নগ্ন অবস্থাতেই। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পরনে থাকে শুধু জাঙ্গিয়ার মত আঁটোসাঁটো স্প্যানডেক্স । অ্যাথলিটদের কিছু কিছু পোশাক আছে, যার একটা প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, মেয়েদের স্তন এবং পুরুষদের যৌনাঙ্গকে জায়গামত আটকে রাখা। অন্যদিকে এই আরাম ছাড়া অ্যাথলিটিকসে একজন ক্রীড়াবিদের পারফরমেন্সের ক্ষেত্রে তার পোশাক আর কী ভুমিকা রাখতে পারে তা ততটা স্পষ্ট নয়।

আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের অধ্যাপক ওলগা ট্রয়নিকভ বলছেন, এটা আসলে নির্ভর করে পোশাকটা কী, তা অ্যাথলিটের দেহের সাথে কতটা মানিয়েছে এবং খেলাটা কী - তার ওপর। তিনি বলছেন, এ্যাথলেটের জন্য পোশাক যা করে তাহলো, তার দেহকে একটা বাঁধুনি দেয় - যার ফলে এ্যাথলেট যা করছেন সেদিকে তার পেশীর শক্তিকে আরো ভালোভাবে সঞ্চালিত হতে পারে। পোশাক থেকে অ্যাথলিটের সুবিধা পাবার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত দেখা যায় সাঁতারের ক্ষেত্রে। এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি হৈচৈ হয় ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের সময়। সেই অলিম্পিকসে সাঁতারুরা মোট ২৫টি বিশ্বরেকর্ড ভেঙেছিলেন, আর তার মধ্যে ২৩টি ভেঙেছিলেন এক বিশেষ ধরনের পুরো শরীর-ঢাকা পলিইউনিথেন সুইমস্যুট পরে - যার নাম দেয়া হয়েছে এলজেডআর রেসার। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা ওই এলজেডআর রেসার স্যুট তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন। নাসা বলছে, এই স্যুট পরার ফলে সাঁতারুর দেহের সাথে পানির ঘর্ষণের মাত্রা ২৪ শতাংশ কমে যায়, এবং এ পোশাক এমনভাবে দেহকে চেপে ধরে রাখে যার ফলে ড্র্যাগ (অর্থাৎ বিপরীতমুখী বাধার ফলে গতি কমে যাবার প্রবণতা) হ্রাস পায়।

এরপরে ২০১০ সালে সাঁতারের আন্তর্জাতিক প্রশাসক সংস্থা ফিনা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে অ্যাথলিটদের মধ্যে যারা এই এলজেডআর রেসারের মত পোশাক পরেছেন তারা অন্যদের তুলনায় অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছেন। ফিনা এখন এমন ধরনের পোশাক পরে প্রতিযোগিতায় নামা নিষিদ্ধ করেছে - যাতে গতি, পারফরমেন্স ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। কার্যত এর অর্থ হচ্ছে, সাঁতারুরা যদি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রতিযোগিতা করেন তাহলে তাদের পারফরমেন্সে তেমন কোন নাটকীয় প্রভাব পড়বে না - স্তন বা পুরুষাঙ্গ ঝুলে থাকার অসুবিধা ছাড়া।

অ্যাথলিটের পোশাকের জন্য অন্য খেলার ফলাফলের ওপর কোন প্রভাব পড়ে কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বলা হয়, আঁটোসাটো খেলার পোশাক - যাকে বলে 'কমপ্রেশন গার্মেন্ট' - এমনভাবে ডিজাইন করা যে তা মানবদেহে রক্তপ্রবাহের ধরন পাল্টে দিয়ে রক্তকে বেশি অক্সিজেন শোষণ করতে সহায়তা করে। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে, কিন্তু তার ফল নিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রায় সমান দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। এসব পোশাক পরে এ্যাথলেটের পারফরমেন্সে কোন উন্নতি ঘটোনোরও তারা বিরোধী।

বলতেই হবে, জুতোর ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা আলাদা - শুধু পারফরমেন্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নয়, খেলোয়াড়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যেও। উপযুক্ত জুতা পায়ের বিভিন্ন অংশকে সহায়তা দেয়, পায়ের পাতার গোল অংশের চারদিকে গদির মত আবরণ তৈরি করে - যাতে দৌড়ানোর সময় অনেক সুবিধা হয়। তা ছাড়া দৌড়-ঝাঁপের ফলে পায়ের হাড়, লিগামেন্ট ও পেশীর ওপর যে অভিঘাত হয় - সেটাও কমাতে ভুমিকা রাখে জুতা। নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির উইলসন কলেজ অব টেক্সটাইলের একজন শিল্প প্রকৌশলী পামেলা ম্যাকলে বলছিলেন, "মানুষের দেহের পুরো ওজনটা বহন করে পা, এবং সেই কারণেই উন্নতমানের জুতা পরাটা এত প্রয়োজনীয়।" নিরাপত্তার জন্য কিছু খেলার ক্ষেত্রে আরো বিশেষ ধরনের জুতার দরকার হয়।

অলিম্পিক সেইলিং বা পাল-তোলা নৌকা চালনার ক্ষেত্রে প্রতিযোগীরা যখন নৌকার পাশ থেকে ঝুলতে থাকেন তখন তারা নির্ভর করেন তাদের বিশেষ ধরনের জুতার ওপর, যা তাদের পিছলে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে এবং ভারসাম্য ঠিক রাখতে সহায়তা করে। ফলে এই জুতা একই সাথে তাদের পারফরমেন্স উন্নত করছে, আবার বিপজ্জনক দুর্ঘটনাও প্রতিরোধ করছে। পামেলা ম্যাকলে বলছেন, "কেউ যদি নগ্ন অলিম্পিক চালু করতে চায় - আমার আপত্তি নেই, কিন্তু অ্যাথলিটকে অন্তত জুতা পরতে দিন।"

নগ্ন অলিম্পিক হলে অনেকে তাতে প্রতিযোগিতা করবেন কিনা সেটাও হতে পারে এক বড় প্রশ্ন। অলিম্পিকে নগ্নতা যদি বাধ্যতামূলক হয় তাহলে জুতো পরার সুযোগ থাকুক আর নাই থাকুক - কিছু অ্যাথলিট হয়তো প্রতিবাদ জানিয়ে এ থেকে বেরিয়ে যাবেন। যেসব দেশ আরো বেশি রক্ষণশীল তারা হয়তো তাদের দেশ থেকে প্রতিযোগীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে পারে। নগ্ন অলিম্পিকে যদি ১৮-বছরের কম বয়স্ক অ্যাথলিটরা অংশ গ্রহণ করে তাহলে এ নিয়ে গুরুতর নৈতিক ও আইনগত প্রশ্নও উঠবে।

প্রাচীন গ্রিক অলিম্পিক ছিল অনেকটা ধর্মীয় প্রকৃতির। তাতে এমনকি ১২ বছরের অ্যাথলিটরাও নগ্ন হয়ে অংশগ্রহণ করতো। সেখানে কোন রকম যৌন কর্মকাণ্ড বা এ্যাথলেটদের যৌন দৃষ্টিতে দেখা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং একে নিন্দনীয় ব্যাপার হিসেবে দেখা হতো। দর্শকরা ছিলেন প্রধানত সমাজের এলিট বা উচ্চশ্রেণীর পুরুষরা । তারা অভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবেশ থেকে আসতেন। কিছু অবিবাহিত নারীকেও অলিম্পিকসে আসতে দেয়া হতো। কিন্তু আজকের যুগ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অলিম্পিকস এখন সারা দুনিয়ার কোটি কোটি দর্শকের কাছে সম্প্রচারিত হচ্ছে। এ অবস্থায় নগ্ন অলিম্পিক হলে কিছু দেশ হয়তো টিভিতে এর সম্প্রচার নিষিদ্ধ করবে। আবার অন্য কিছু উদারনৈতিক দেশে হয়তো মিডিয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে এই ইভেন্ট নিয়ে দেখা দেবে ব্যাপক উত্তেজনা।

দর্শকদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হবে খুবই মিশ্র। কারণ একজনের চোখে যদি কোন কিছুকে শৈল্পিক, মহৎ বা গৌরবজনক মনে হয়, আরেকজন হয়তো সেটাকেই একটা জঘন্য জিনিস বলে মনে করবে। সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাবে, এ নিয়ে বিচিত্র ধরনের মতামত। যেসব এ্যাথলেটের দেহ নিয়ে ভালো বা মন্দ কথা বলা হবে - হয়তো তাদের পারফরমেন্সের ওপরও এর একটা প্রভাব পড়বে। আবার এমন কিছু অ্যাথলিটও হয়তো দেখা যাবে যে তারা তাদের প্রতি মানুষের এই আগ্রহকে খুব পছন্দ করছেন।

উনিশশো নিরানব্বই সালে মেয়েদের বিশ্বকাপে ফলাফল নির্ধারণী গোলটি করার পর তার জার্সি খুলে ফেলেছিলেন ব্রাণ্ডি চেস্টেইন। স্পোর্টস ব্রা পরা ব্রান্ডির সেই ছবি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল। কিন্তু পুরুষ অ্যাথলিটদের সারাক্ষণই শার্টবিহীন অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। অলিম্পিকে নগ্নতা যদি গৃহীত হয়ে যায়, তাহলে এক সময় হয়তো এমনটাও হতে পারে যে, একজন অ্যাথলিটের নগ্নতাকে সমাজ আবার বীরত্ব আর গৌরবের চোখে দেখতে শুরু করবে - যেমনটা প্রাচীন গ্রিসে ছিল। কিন্তু তা যতদিন না হবে - ততদিন পর্যন্ত নগ্নতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সমাজে যে সাংস্কৃতিক বিচারবোধ তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলা করার মানসিক চাপের কারণে হয়তো অনেক অ্যাথলিটেরই পারফরমেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব কারণে - প্রথম নগ্ন অলিম্পিকে যারা বিজয়ী হবেন, তারা হয়তো সেই বিজয় পাবেন তাদের অ্যাথলিটিক নৈপুণ্যের জন্য ততটা নয়, যতটা প্রাচীন গ্রিকদের মত মানসিক শক্তির কারণে। সূত্র : বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আবেদ ২৯ জুলাই, ২০২১, ১০:৩৮ পিএম says : 0
একদম ফালতু ফিচার। ইনকিলাবে এসব মানানসই নয়
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন