বনী আদমের আসল আবাস জান্নাত। কিছু দিনের জন্য তাদের দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। আবার আমাদেরকে জান্নাতে যেতে হবে। তবে এমনিতেই নয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। দুনিয়া দারুল ইমতিহান-পরীক্ষার ক্ষেত্র। ভালো ও মন্দ, ফুল ও কাঁটার মিলনেই দুনিয়া। আনন্দ ও বেদনা, আলো ও অন্ধকার এখানে পাশাপাশি অবস্থান করে। মানুষের জীবনে কখনো সুখ আর সুখ, প্রাচুর্য আর প্রাচুর্য এবং কখনো বা দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত হয়ে পড়ে জীবন। এ উভয় আবস্থা মিলেই মানুষের জীবন।
স্বাভাবিকভাবে আমরা দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক, অভাব-অনটন ইত্যাদিকেই কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করি। কিন্তু বাস্তবতা হল, দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রীতিকর অবস্থা যেমন পরীক্ষা তেমনি সুখ-শান্তি, সম্পদ-প্রাচুর্য, আরাম-আয়েশ, স্বস্তি-সুস্থতা ইত্যাদি কাক্সিক্ষত ও প্রীতিকর অবস্থাও পরীক্ষার বিষয়। আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারীমে এবিষয়ে আমাদের সচেতন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : আর আমি মন্দ ও ভালো দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করি। (সূরা আম্বিয়া : ৩৫)।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম রাহ. বলেন, অর্থাৎ তোমরা যেসব বিষয় পছন্দ কর (যেমন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, স্বস্তি-সুস্থতা, ধন-ঐশ্বর্য ইত্যাদি) এবং যা কিছু অপছন্দ কর (যেমন দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, রোগ-শোক ইত্যাদি) সবই পরীক্ষা। উদ্দেশ্য- যাচাই করা যে, তোমরা পছন্দ ও কাক্সিক্ষত বিষয়ের শোকর কর কি না এবং অপছন্দ ও অনাকাক্সিক্ষত অবস্থায় সবর কর কি না। (তাফসীরে তবারী : ১৪/৪৪০)।
ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, অর্থাৎ আমি কখনো তোমাদের উপর বিপদ-আপদ নাযিল করি এবং কখনো নিআমতরাজি দান করি। উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষা করা যে, নিআমত পেয়ে কে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, আর কে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে। এবং দুঃখ-কষ্টে কে সবর করে, আর কে নিরাশ হয়ে যায়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর : ৫/৩৪২)।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : তাদের মধ্যে কতক ছিল সৎকর্মশীল এবং কতক অন্য রকম। আমি তাদেরকে ভালো ও মন্দ অবস্থা দ্বারা পরীক্ষা করেছি, যাতে তারা (সঠিক পথের দিকে) ফিরে আসে। (সূরা আরাফ : ১৬৮)। ইবনে জারীর তবারী রাহ. বলেন, এই আয়াতে ‘হাসানাত’ বা ভালো অবস্থা দ্বারা উদ্দেশ্য- সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ ও সচ্ছলতা। আর ‘সায়্যিআত’ বা মন্দ অবস্থা দ্বারা উদ্দেশ্য- দুঃখ-কষ্ট, বালা-মসিবত ও দরিদ্রতা। (তাফসীরে তবারী : ১৩/২০৮-২০৯)।
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যে মানুষকে সুখ ও দুঃখ, বিপদ ও স্বস্তি, সুস্থতা ও অসুস্থতা, অভাব ও সচ্ছলতা ইত্যাদি বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত অবস্থা দিয়েছেন, এর উদ্দেশ্য- মানুষকে পরীক্ষা করা। কারো জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যে ঘেরা, কেউবা দুঃখ-দুর্দশায় ন্যুব্জ; কিন্তু পরীক্ষার ভেতর আছে সকলেই এবং সব অবস্থা-ই পরীক্ষার অবস্থা। রোগ-শোক, দৈন্য-দুর্দশা যে পরীক্ষা, মানুষ সাধারণত তা বোঝে।
তাই এসব হালতে মানুষ সবর করার চেষ্টা করে। একে-অপরকে সবরের নসীহত করে। মানুষের দিল-মন তখন কিছুটা হলেও আল্লাহর দিকে রুজু হয়। এমনকি কাফের-মুশরিকরাও বড় বড় মসিবতের সময় আল্লাহকে ডাকতে শুরু করে। আল্লাহ তাআলা বলেন : তরঙ্গমালা যখন তাদেরকে আচ্ছন্ন করে মেঘচ্ছায়ার মতো তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। এরপর তিনি যখন তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে নিয়ে আসেন তখন তাদের কিছুসংখ্যক সরল পথে থাকে। (অবশিষ্ট সকলে পুনরায় শিরকে লিপ্ত হয়) আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে কেবল এমন লোক, যে ঘোর বিশ্বাসঘাতক, চরম অকৃতজ্ঞ। (সূরা লুকমান : ৩২)।
এর বিপরীত সুখ-শান্তি, ধন-সম্পদ, স্বস্তি-সুস্থতা ইত্যাদি নিআমত যে পরীক্ষার বস্তু, সাধারণত আমরা তা বুঝি না। বুঝলেও এসব নিআমতের কদর করি না। এর শোকর আদায়ের চেষ্টা করি না। অথচ আল কোরআন কত চমৎকার শৈলী এবং কত বৈচিত্র্যপূর্ণ পদ্ধতিতে আমাদেরকে নিআমত ও প্রাপ্তির পরীক্ষার কথা স্মরণ করিয়েছে! ইরশাদ হয়েছে : ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার জন্য শোভাকর বানিয়েছি, মানুষকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তাদের মধ্যে ভালো কাজ করে। (সূরা কাহ্ফ : ৭)।
অর্থাৎ পৃথিবীতে যত শোভা ও সৌন্দর্য, আরাম-আয়েশের যত উপকরণ, সবই পরীক্ষার বস্তু। এর মাধ্যমে যাচাই করা হবে- কে দুনিয়ার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায়, আর কে এসব নিআমতকে আল্লাহ তাআলার হুকুমমত ব্যবহার করে নিজের জন্য আখেরাতের পুঁজি সঞ্চয় করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন