সৃষ্টি বিকাশের পূর্বেই মহান আল্লাহ পাক সংখ্যাতাত্তি¡কভাবে সৃষ্টির ক্রমধারা অব্যাহত রাখার উদ্দেশে সংখ্যার বিষয়টিকে প্রাধান্য প্রদান করেছেন। কেননা, সংখ্যা ছাড়া অগণিত সৃষ্টির সুশৃঙ্খল অগ্রযাত্রা কল্পনা করা যায় না। বাংলা ভাষায় আমরা সংখ্যা বা ১,২,৩,৪ ইত্যাদি বলতে যা বুঝি, তার আরবি পরিভাষা হলো ‘আদদ’। আল কোরআনে ‘আদদ’ শব্দটি তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে।
যথা : (ক) এরশাদ হয়েছে : ‘যখন আমি কয়েক বছরের জন্য (আদাদা-সীনিনা) গুহায় তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা ঢেলে দিলাম।’ (১৮নং সুরা কাহফ : আয়াত-১১)। (খ) এরশাদ হয়েছে : ‘এমন কি যখন তারা প্রতিশ্রুত শাস্তি দেখতে পাবে, তখন তারা জানতে পারবে, কার সাহায্যকারী দুর্বল এবং কার সংখ্যা কম (আকাল্লা আদাদা)।’ (৭২নং সুরা জ্বিন : আয়াত-২৪)। (গ) এরশাদ হয়েছে : ‘যাতে আল্লাহ তায়ালা জেনে নেন যে, রাসুলগণ তাদের পালনকর্তার পয়গাম পৌঁছিয়েছেন কি-না, রাসুলগণের কাছে যা আছে তা তার গোচরীভূত এবং তিনি সব কিছুর সংখ্যার হিসাব রাখেন। (৭২নং সুরা জ্বিন, আয়াত-২৮)।
এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, মহান রাব্বুল আলামীন সুরা জ্বিনের সর্বশেষ বাক্যে বলে দিয়েছেন যে, তিনি প্রতিটি বস্তুর সংখ্যার হিসাব রাখেন। অর্থাৎ ‘প্রতিটি বস্তুর পরিসংখ্যান আল্লাহ তায়লার গোচরীভ‚ত। পাহাড়, পর্বতের অভ্যন্তরে কি পরিমাণ অণু-পরমাণু আছে, সারা বিশ্বের জলাধিসমূহের মধ্যে কি পরিমাণ পানিবিন্দু আছে, প্রত্যেক বৃষ্টিতে কত সংখ্যক ফোঁটা বর্ষিত হয় এবং সারা জাহানের বৃক্ষসমূহের পত্র-পল্লবের সঠিক পরিমাণ তাঁর জানা আছে।’ মোটকথা, তিনি যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর পরিমাণ, পরিমিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছেন।
এর দ্বারা এ কথাও প্রতিপন্ন হয় যে, সৃষ্টি বিকাশের পূর্বের তিনি এর সংখ্যাতাত্তি¡ক হিসাব-নিকাশের কাজ সমাধা করে রেখেছিলেন। এ জন্য সংখ্যা ও সংখ্যাতাত্তি¡ক পরিসংখ্যান যথাযথরূপে বুঝা উপলব্ধি করা ও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা মানুষের জন্য সহজতর হয়ে উঠেছে। এটা আল্লাহ পাকেরই বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। তা’ না হলে এই পৃথিবীতে নিয়মশৃঙ্খলা বলতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। বাংলা ভাষায় আমরা যে সংখ্যাটিকে ছয় (৬) বলি, তার আরবী নাম হলো ছিত্তাতুন।
এই ‘ছিত্তাতুন’ (ছয়) শব্দটি আল কোরআনে ৭ বার ব্যবহৃত হয়েছে। যথা : (১) এরশাদ হয়েছে : ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক আল্লাহ যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে (ফি ছিত্তাতি আইয়্যাম) সৃষ্টি করেছেন।’(৭নং সুরা আ’রাফ : আয়াত-৫৪)। (২) এরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিনকে ছয়দিনে।’ (১০নং সুরা ইউনুস : আয়াত-৩)।
(৩) এরশাদ হয়েছে : ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি আসমান ও জমিন ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন।’ (১১নং সুরা হুদ : আয়াত-৭)। (৪) এরশাদ হয়েছে : ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অন্তর্বর্তী সব কিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন।’ (২৫নং সুরা ফুরকান : আয়াত-৫৯)। (৫) এরশাদ হয়েছে : ‘আল্লাহ, যিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন।’ (৩২নং সুরা সেজদাহ : আয়াত-৪)। (৬) এরশাদ হয়েছে : ‘আমি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি এবং আমাকে কোনো রূপ ক্লান্তি স্পর্শ করেনি।’ (৫০নং সুরা ক্বাফ : আয়াত-৩৮)।
(৭) এরশাদ হয়েছে : ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয়দিনে।’ (৫৭নং সুরা হাদীদ : আয়াত-৪)। বস্তুত : আল্লাহ পাকের সৃষ্টি কৌশলের বাস্তবায়ন দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আলমে আমর বা ‘নির্দেশ জগত’। সে জগত বস্তুহীন। সেখানে আল্লাহ পাক ‘কুন’ বলার সাথেই তাঁর প্রার্থিত বস্তুটির পূর্ণাঙ্গ ‘স্মৃতি’ তৈরি হয়ে যায়। এ জগত আল্লাহ পাকের আরশে মোয়াল্লার উপরে অবস্থিত। (২) আলমে খালক বা ‘সৃষ্টি জগত’। এ জগতহলো বস্তুময়। এখানে ‘ফাইয়াকুন’ পদ্ধতিতে আল্লাহ পাকের প্রার্থিত বস্তুর পূর্ণাঙ্গ স্মৃতি তরতীব মতো ধাপে ধাপে, পর্যায়ক্রমে বাস্তবে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
এ জন্য আরশে মোয়াল্লা হতে শক্ত স্তর জমিনের নিম্নভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। দিন ও রাতের আগমন নিগর্মনের ক্রমধারা সৃষ্টি জগতের সূর্য ও চন্দ্রের উদয় অস্তের সাথে জড়িত। ‘নির্দেশ জগতে’ এদিন এবং রাতের প্রভাব বলতে কিছুই নেই। সেযাই হোক, আমরা পরবর্তী পর্যায়ে ছয়দিনে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থিত বস্তু সৃষ্টির ব্যাপারে বিশাদ আলোচনা করতে প্রয়াস পাব। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের তাঁর রহমত ও বরকতের শামিয়ানার নিচে স্থান দান করুন।-আমীন!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন