বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আফগানিস্তান

| প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো বাহিনীর সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিল, ছয় মাসের মধ্যে তালেবান আফগানিস্তান দখল করে নেবে। এ আভাসের চেয়েও কম সময়ের মধ্যে তালেবান পুরো আফগানিস্তান পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিগত কয়েক মাসে তালেবানরা আফগানিস্তানের সবকটি প্রদেশ যে অবিশ্বাস্য গতিতে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কাবুল অভিমুখী হয়, তা ছিল বিস্ময়কর। তাদের এই অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা গঠিত আধুনিক সমরাস্ত্রসম্পন্ন অত্যন্ত শক্তিশালী আফগান বাহিনী কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিরোধ ছাড়া তালেবান শান্তিপূর্ণভাবে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে। এটি যেমন তালেবানের বিজয়, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম অপমানজনক পরাজয়। ৪৬ বছর আগে ভিয়েতনাম থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে এভাবেই পরাজয় বরণ করে পাততাড়ি গুটিয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল। বলা হচ্ছে, ভিয়েতনামের চেয়েও করুণ পরাজয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্টদের সঙ্গে হার মেনে বিদায় নিয়েছিল। এবার ইসলামপন্থী তালেবানের সঙ্গে না পেরে বিদায় নিয়েছে। যদিও পেন্টাগনের মুখপাত্র আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়াকে পরাজয় বলে মানতে নারাজ। তার মতে, নিজেদের লোকজনকে রক্ষা করতে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করা হয়েছে। এটি যে যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয় তা বিশ্ববাসী ভালো করেই বুঝেছে। তালেবান কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তাজিকিস্তানে পালিয়ে গেছেন।

সুদূর অতীত থেকেই আফগানিস্তান বিভিন্ন দেশ ও আগ্রাসী শক্তির দ্বারা আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। বৃটেন থেকে রাশিয়া এবং সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রও আগ্রাসন চালিয়েছে। তবে কোনো কালেই তারা দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। প্রতিরোধের মুখে একটা সময় তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। সেসব বিদায় সুখকর হয়নি এবং দখলদারিত্ব থেকেও তাদের কোনো লাভ হয়নি। পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই ফিরতে হয়েছে। ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রজোট তৎকালীন তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রানাধীন একটি পুতুল সরকার গঠন করে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে দেশটির সামরিক বাহিনী গঠন এবং নিজের ও ন্যাটো জোটের সামরিক ঘাটি স্থাপন করে। তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দমন অভিযান চালাতে থাকে। অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত তালেবান দীর্ঘ দুই দশক ধরে আভ্যন্তরীণ ও বির্হিশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এ সময় আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও তার তল্পিবাহক সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতসহ কিছু দেশ সেখানে অবকাঠামোসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা শুরু করে। তবে কেউই ধারণা করতে পারেনি তালেবান পুনরায় আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফিরতে পারবে। মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়ার পর জো বাইডেনের চূড়ান্ত ঘোষণাই পুরো দৃশ্যপট বদলে দেয়। আফগানিস্তান থেকে ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তির খাতা শূন্য এবং বিপুল অর্থ ও সৈন্য হারানোর ক্ষতি থেকে সরে আসার প্রেক্ষাপটেই দেশটি লেজ গুটাতে বাধ্য হয়। এতে বর্হিশত্রু থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য তালেবানের নিরন্তর সংগ্রাম তখন থেকেই বেগবান হতে শুরু করে। তিন মাস আগে থেকে তারা কাবুলমুখী অভিযান শুরু করে। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে একের পর এক প্রদেশ বিনা বাধায় নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। অথচ আধুনিক সমরাস্ত্র সমৃদ্ধ আফগান সামরিক বাহিনীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬৯৯। এর বিপরীতে তালেবানের সংখ্যা ৭৫ হাজারের মতো। তিন গুণের বেশি শক্তি নিয়েও গণি সরকার তালেবানের অগ্রযাত্রা রোধ করতে পারেনি। এর কারণ কি? এ প্রশ্নের জবাব হতে পারে, তালেবানের প্রতি আফগান জনগণের বিপুল সমর্থন। জনগণের সমর্থন ছাড়া কারো পক্ষেই কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। তালেবানের প্রতি আফগান জনগণের সমর্থন ছিল বলেই তারা এক অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, ২০ বছর আগের তালেবান আর বর্তমান তালেবানের নীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তালেবানের শক্তিমত্তার প্রধান কারণ হচ্ছে, তাদের কৌশলী ক‚টনীতি। তারা একই সঙ্গে বিশ্বের সব কটি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও দর-কষাকষির পারঙ্গমতা অর্জন করতে পেরেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স¤পাদন করেছে, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে সফল হয়েছে। এমনকি নিরাপত্তার বিষয়ে শিয়া-অধ্যুষিত ইরানকেও আশ্বস্ত করেছে। বিপরীতে কাবুলের সরকার অতিমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছিল। আশরাফ গনির সরকার বুঝতে পারেনি, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মিত্রতা কাবুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে, তালেবান বর্হিবিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশসহ প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়েছে। তালেবানের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার এক মুখপাত্র বলেছেন, মূলনীতি বা আদর্শের কখনো পরিবর্তন হয় না। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে সময়ের সঙ্গে চলার ছন্দে পরিবর্তন আসতে পারে। এটি জীবন ও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তিনি আরও বলেছেন, আফগানিস্তানের মানুষ মুসলমান। আফগান সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগুলোই এমন যে সেগুলো ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা কারো এমন কোনো অধিকার হরণ করতে চাই না। আফগানিস্তানের অন্য ধর্মাবলম্বীরাও আফগানিস্তানেরই সন্তান। তারাও তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা পুরোপুরি উপভোগ করবে। কেউ তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। তিনি বলেছেন, নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের নীতি সবসময় স্পষ্ট। ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাসী। ইসলামে নারী শিক্ষা, কাজ ও মালিকানার অধিকার রয়েছে। তালেবান মুখপাত্র এও বলেছেন, আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাই। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে চাই। আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করতে চাই। দেখা যাচ্ছে, দুই দশক আগের তালেবান আর বর্তমান তালেবানের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আফগানিস্তানকে তাদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যেই একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।

আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ নিয়ে পরাশক্তির দেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে এবং করবে। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। পরিস্থিতি বুঝে এবং নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা অন্য কোনো দেশ কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল তা দেখে অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে আফগানিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। একইসঙ্গে আফগানিস্তান সার্ক-এর সদস্য। আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে আমাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে কারো সাথে বৈরিতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব, এই নীতি অবলম্বন করতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack Ali ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:১১ পিএম says : 0
আল্লাহ সমস্ত দুনিয়া তোমার বাংলাদেশের মাটির ও তোমার তুমি আমাদেরকে এই জালেম সরকার থেকে রক্ষা করে ইসলামিক আইন দিয়ে দেশ চালানোর ব্যবস্থা করে দাও
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন