জাতীয় অর্থনীতিতে চামড়া শিল্প উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। বর্তমানে এ খাত রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এখাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পণ্যে উচ্চমূল্য সংযোজনের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্পখাতকে জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-এ উচ্চ অগ্রাধিকার খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বিশ্বব্যাপী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদার মাত্র ৩ শতাংশ বাংলাদেশ পূরণ করে। বিগত কয়েক দশকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে কাঠামোগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে এখাতের ৬২ শতাংশ রপ্তানি আয় ফিনিসড লেদার হতে এলেও ২০১৪ সালে এটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে। অপরদিকে, ২০০৩ সালে এই খাতের মোট রপ্তানি আয় পাদুকাশিল্প হতে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে সেটি ৪৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশীয় পাদুকা শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি ও গুণগতমানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশি উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসছে।
বর্তমানে বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থের বাজার রয়েছে। এ বিশাল বাজারের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ধরার জন্য পর্যাপ্ত কাঁচামালের যোগান আমাদের দেশে রয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতিবছরে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া জবাই করা হয়। এ বিশাল পরিমাণ কাঁচামালকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য জাতীয় অর্থনীতিতে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার গুণগতমান ভালো হওয়ায় আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি চামড়াজাত পণ্যের ব্যাপক সুনাম ও চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হতে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৬১ লাখ ডলার, যা পূর্ববর্তী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের ন্যায় উৎপাদনমুখী চামড়া শিল্প খাতও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬.২২ শতাংশ বেশি হয়েছে। এসময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার নির্ধারণ করা হলেও প্রায় ৯ কোটি ডলার আয় হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমানসম্পন্ন ক্রেতা পেতে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের মানদন্ড অর্জন অপরিহার্য। দেশে উৎপাদিত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সাভারে অবস্থিত চামড়া শিল্প নগরীতে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে অত্যাধুনিক কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। কঠিন বর্জ্যের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তবে, লেদার ওয়ার্কিংগ্রুপের সার্টিফিকেট অর্জনে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সাথে জড়িত ট্যানারিসমূহের অন্যান্য শর্তাবলি অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
বর্তমানে মানবসভ্যতায় প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও এটির ব্যবহারের প্রবণতা দিনদিন শক্তিশালী হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভূত উন্নয়নের ফলে সারাবিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মুখোমুখি। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে এই শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় উৎপাদন খাতেও এসকল উদ্ভাবনের প্রভাব পড়ছে। এর ফলে ইতোমধ্যে সরবরাহ পদ্ধতিসহ সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় গুণগত পরিবর্তন আসছে। উৎপাদন কার্যক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় হ্রাস করে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। ফলে, সমগ্র উৎপাদন খাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের কাজ করার সুযোগ ক্রমশ কমে আসছে। একইভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দক্ষ জনসম্পদের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি কিছু কিছু কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার পুনর্বিন্যাসও পরিলক্ষিত হচ্ছে। আসন্ন এ শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদন কার্যক্রমে প্রথাগতভাবে যে সকল কাজ মানুষের দ্বারা সম্পন্ন হয়, সেগুলোর অনেকগুলোই যান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন হবে। এর ফলে স্বল্পদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে। তবে নতুন দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ শিল্পবিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের যে সকল উৎপাদন খাত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে, চামড়া ও পাদুকা শিল্প তার অন্যতম। এছাড়া রেডিমেড গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল, ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি, আসবাবপত্র ও এগ্রোফুড খাতও প্রভাবিত হচ্ছে এবং আগামীতে এ ধারা চলমান থাকবে। তাই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির যেমন অপার সম্ভাবনা রয়েছে, একই সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পপণ্য উৎপাদন খাতের সকল পর্যায়ের বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থান ঝুঁকির সম্মুখীন হবার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন: ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে চামড়া ছাটাই, শুকানো ও ট্যানিংয়ের জন্য প্রয়োজন মোতাবেক রাসায়নিক প্রস্তুত, চামড়াজাত পাদুকা উৎপাদন শিল্পে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে চামড়া কাটা, লাসটিং করা, অ্যামবোসিং ও স্ট্যাম্পিং, ফিনিসিং ও পাদুকার উপরিভাগ সেলাই করা এবং অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে চামড়ার প্রান্ত সরু করা, স্প্লিটিং করা, অ্যামবোসিং ও স্ট্যাম্পিং করা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনখাতের প্রতিষ্ঠানসমূহ নানাভাবে উপকৃত হবে। বিশেষ করে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন খরচ যেমন হ্রাস পাবে তেমনি উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এসকল প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবারমান বৃদ্ধি পাবে এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন খাতে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান এ খাতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে পরিকল্পিত উপায়ে এ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। আরও একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব। এ খাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় কোর্স পরিচালনার জন্য টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠানসমূহের দ্রুত এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন