যুগে যুগে আজানের ধ্বনি ও মর্মস্পর্শী সুর মানবমনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে এবং এর মাধ্যমেও বহু মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করেছে। বর্তমানে শুদ্ধতার নামে আজানকে গদ্যের মতো কথামালায় রূপান্তরিত করার যে নিয়ম চালু হচ্ছে তা একদেশদর্শী চিন্তা। ইসলামী শরীয়াহ এমন নির্দেশনা দেয়নি। (মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. রচনাবলী)। মক্কা মদীনার পবিত্র দুই মসজিদ, মিসর, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরাক ও উপমহাদেশের আজান যেরকম ঐতিহ্য নিয়ে চলে এসেছে, এটিই আজানের রূপ। কোনো উচ্চারণগত ভুল না থাকলে এ মধুর ধ্বনিকে গদ্যে পরিণত করার কোনো প্রয়োজন নেই।
ইমাম খতিব ও কিরাতবিদদের বেলায় যেমন হুসনে লাহন ও সওত অর্থাৎ সুললিত কণ্ঠ আকর্ষণীয় উচ্চারণ খোঁজা হয়, মসজিদের মুয়াজ্জিন’র জন্যও সুন্দর কণ্ঠস্বর ও আওয়াজের অধিকারী হওয়া আবশ্যিক। বর্তমানে দেশে অনেক মসজিদেই কর্কশ আওয়াজে, সীমাতিরিক্ত ভলিউমে এমন আজান শোনা যায়, যার প্রতি মানুষের কোনো আন্তরিক টান, আধ্যাত্মিক আকর্ষণ বা শ্রুতিমধুরতা পরিলক্ষিত হয় না। শহরাঞ্চলে একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটে বসে একই সাথে আপনি ৫/৭ টি মসজিদের অপরিমিত উচ্চ আওয়াজের ৫/৭ টি আজান শুনবেন, একজন মুমূর্ষু রোগী, একজন পরীক্ষার্থী বা অবোধ শিশুকে প্রতিদিন এ শব্দের মুখোমুখি হতেই হবে, যা ইসলাম আমাদের বলেনি।
আজানের উদ্দেশ্য মানুষকে কষ্ট দেয়া নয়। কিন্তু লাখো মসজিদ এমনও আছে, যেখানকার আজানের ধ্বনি শ্রোতার হৃদয়কে স্পর্শ করে। তার মনে স্বস্তি ও প্রশান্তি এনে দেয়। আরব, তুরস্ক, বোখারা, সমরকন্দ, ভারত, পাকিস্তানের আজান যেমন একটি ঐতিহ্যের উপর চলে এসেছে। সুতরাং দেশের মসজিদগুলোতে বিশুদ্ধ অথচ আকর্ষণীয় আজান চালু থাকতে হবে। গদ্য আজানের প্রচলন শরীয়তের চাহিদা নয়। মাইকের শব্দ মসজিদের আওতাধীন মুসল্লিদের নিজ এরিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। দিনের বেলা সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবেল, রাতে সর্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবল শব্দ স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও আইনসম্মত। কিছু মানুষের বোকামির জন্য রহমতের আজান যেন মানুষের জন্য আজাবে পরিণত না হয়। যাদের আচরণ দেখে মনে হয়, দীনি কাজে শব্দ যত বড়, সওয়াব তত বেশি।
সমাজের হারানো বিজ্ঞপ্তি, শোক সংবাদ বা শালিস দরবারের ঘোষণা প্রচারের জন্য মসজিদের মিম্বার নয়। এটি জনগুরুত্বপূর্ণ বড় কোনো বিষয় যেমন যুদ্ধ, বিমান হামলা, ডাকাত, অগ্নিকান্ড ইত্যাদির সতর্কবাণী প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, যেনতেন ব্যাপারে নয়। বর্তমানে মসজিদের মাইকে অবাধে নানা বিষয়ের এলান হতেই থাকে। এখানেও প্রয়োজন, অতি প্রয়োজন বা অপ্রয়োজন এর বাছ বিচার থাকা জরুরি। যাতে আজানের ব্যবস্থাটির বিধিগত মর্যাদা হ্রাস না পেতে পারে। হাদীস শরীফে আছে, নবী করিম (সা.) আজানের পর আবার কোনোভাবে মানুষকে নামাজের জন্য আনুষ্ঠানিক আহ্বান করাকে নিষেধ করেছেন। কেননা, আজান শরীয়তে বিধিবদ্ধ একটি ইবাদত। এর গুরুত্ব কমার মতো অন্য কোনো বিকল্প রাখা যাবে না।
ছোট্ট একটি সভা, ২/৪ শ মানুষের আয়োজন। মাইক লাগানো হয় একটি মহাসমাবেশের পরিমাণ। ২/৪ বর্গমাইল জুড়ে মাইকের হর্ন। মনযোগ দিয়ে কেউ কিছছুশুনছে না তবে কষ্ট পাচ্ছে গোটা এলাকার মানুষ। বিরক্ত হলেও কেউ কিছু বলতে পারছে না, কারণ বিষয়টি ধর্মীয় সংবেদনশীল। অথচ এটি ধর্মীয় দৃষ্টিতেও অনুমোদিত নয়। মানুষকে কষ্ট দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। এসব অহেতুক বাড়াবাড়ির ফলেই ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি আজান, নামাজ, মাহফিল ইত্যাদির বিপক্ষে কথা বলার ছুঁতো খুঁজে পায়। অতএব আমাদের নিজেদের অবুঝ লোকেদের ভুলগুলো আমাদেরকে ধীরে ধীরে শোধরাতে হবে। আর বিবেকবান মানুষকে, চিন্তাশীল আলেম, ইমাম, মুফতিগণকে সত্য কথাটি বলতেই হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ সত্য উচ্চারণে কুণ্ঠিত নন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন