করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ সময়ে সরকার বিটিভি ও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করলেও তাতে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। দূর অঞ্চলের অসংখ্য দরিদ্র শিক্ষার্থীর পক্ষে অনলাইনে কিংবা টিভির ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। ফলে এ সময়ের মধ্যে অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার যে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞরা ব্যক্ত করেছিলেন, বাস্তবেও তাদের সেই আশঙ্কা সত্য হতে দেখা যাচ্ছে। চরাঞ্চলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশজুড়ে বেসরকারি অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাকালীন সময়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় কর্তৃপক্ষ স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। শত শত কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুমল্লিায় ৪৮৫টি, রাজশাহীতে দেড় শতাধিক, টাঙ্গাইলে ২০২টি, নেত্রকোনায় সাড়ে ৩০০টি, বরিশালে শতাধিক, পাবনায় প্রায় আড়াইশ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশজুড়ে আরও অসংখ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এবং ঝরে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছে। এতে সার্বিক শিক্ষা খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও অসংখ্য বেসরকারি ও নন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং খুলতে না পারার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি এবং সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। তবে এর বাইরে বাড়ি ভাড়া করে যেসব কিন্ডারগার্টেন ও স্কুল চলছিল, করোনার কারণে আর্থিক সংকটের মুখে অনেকগুলো খোলা সম্ভব হয়নি। অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক এগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী অন্য স্কুলে ভর্তি হলেও, অনেকে ভর্তি হচ্ছে না। এরা ঝরে পড়ার মধ্যে রয়েছে। সার্বিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এ এক অশনি সংকেত। বিগত দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়া সম্ভব না হওয়ায় কিংবা নামকাওয়াস্তে অনলাইনে ক্লাস নেয়া এবং অটোপাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করায় তাদের প্রকৃত মেধা বিকাশের পথটি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার এই ক্ষতি সহসা পূরণ হওয়ার নয়। তারপরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে অসংখ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষা খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের চিত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনার আওতায় এনে চালু করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো বন্ধ রয়েছে। এ মাসের শেষের দিকে কিংবা আগামী মাসে এগুলো খুলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি টিকার আওতায় না এনে খুলে দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এটিও একটি শঙ্কার বিষয়। শিক্ষার্থীদের টিকা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির হার ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি টিকা দিয়ে মেডিক্যাল কলেজ খোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও পুরোপুরি টিকার আওতায় আনা ছাড়া বিকল্প নেই। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় সংক্রমণের হার বেড়েছে। এ অভিজ্ঞতা সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার কার্যক্রম বাধ্যতামূলকভাবে চালানো অপরিহার্য। সরকার ইতোমধ্যে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা অ্যাপে টিকা সম্পন্ন করার কথা বলেছে। টিকা নিবন্ধন সম্পন্ন করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে গিয়ে টিকা নিতে বলেছে। তবে এ সময়ের মধ্যে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পক্ষে টিকা নেয়া সম্ভব কিনা, তা নিয়েও সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। এ কাজটি অনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে করা হলে ভালো হতো।
করোনা পরিস্থিতি যেরকম হোক না কেন, একে মেনে নিয়েই শিক্ষাসহ অন্যান্য সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে হবে। উন্নত বিশ্বসহ অন্যান্য দেশ এখন এ নীতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও এ নীতি অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এক্ষেত্রে গণটিকা কার্যক্রমসহ টিকা উপযোগী শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান দ্রুত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকা দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বেগবান করতে হবে। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর কোনো অজুহাতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাতে বন্ধ করতে না হয়, এ ব্যাপারে সরকারকে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা পাওয়ার বিষয়টি সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে ক্যাম্পাসে টিকা কেন্দ্র করে পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো চালু করার জন্য আর্থিক সহায়তাসহ অন্যান্য উদ্দীপনামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন