পৃথিবীর দেশে দেশে প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গবেষক, লেখক, গণমাধ্যমকর্মী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদে সোচ্চার হন মাঠেময়দানে, লেখালেখিতে। কারণ পরিবেশ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যের সাথে মানুষের জীবন, অর্থনীতি, পর্যটন প্রভৃতির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বৈরিতায় শেষমেষ ক্ষতি হয় মানুষেরই। আমাদের প্রাণ প্রবাহকে সচল রাখতে উপক‚লের মানুষের জীবন, অর্থনীতি, সম্পদকে রক্ষায় ইউনেস্কো ঘোষিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে পত্রিকায় একটি খবর প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ হওয়ার পর প্রকৃতি রক্ষায় আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যার দাবি রাখে। শুরুতেই বলা সঙ্গত যে, আমরা আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশ্বের উন্নত সমৃদ্ধ দেশ থেকে যোজন যোজন দূরে রয়েছি। পরিণামে প্রকৃতিও আমাদের উপর সেই প্রতিশোধ নিচ্ছে বিভিন্ন সময়ে।
বিশ্বের মধ্যে একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক নানা কারণ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ফলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনে প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ হুমকির মুখোমুখি। সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে। স্বাদু ও লোনা পানির একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় যে প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাকেই ম্যানগ্রোভ ইকোলজি (বাস্তুতন্ত্র) বলা হয়। এখানকার পানিকে ব্রাকিশ ওয়াটার বলা হয়। এ কারণে এই পানির প্রভাবাধীন এলাকাকে ব্রাকিশ ওয়াটার জোন বলে। এই প্রতিবেশ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে জীববৈচিত্র্যের আধার। ম্যানগ্রোভ বা বিশাল পরিমাণের বনের কারণে উদ্ভিদের পাতা পানির সঙ্গে মিশে জলজ প্রাণী, বিশেষত মাছের খাবার জোগান দেয়। এখানকার মাছ এ কারণে অনন্য স্বাদের। সা¤প্রতিককালে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমেছে; বিশেষত উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে জোয়ারের পানি অর্থাৎ সাগরের লবণাক্ত পানির চাপ বেড়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমাদের মিষ্টি পানির উৎস হচ্ছে পাহাড়বাহিত নদী ও বৃষ্টির পানি। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং উজানের নদীগুলো থেকে একেবারেই পানি না আসায় জোয়ারের চাপে সাগরের পানি বেশি চলে আসায় নোনার আধিক্য ধরা পড়ে, যা বৃষ্টি হলেই কমে যায়। উজানের নদীগুলোর পানি নানাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমাদের এখানে মিষ্টি পানির সংকট দেখা দেয়। বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখন লবণাক্ত পানির দাপট বেশি থাকে। উপরন্তু পশ্চিমাংশে বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে নোনার তেজ বেড়েছে। মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার বাড় বাড়ন্তে অনেক প্রজাতির গাছ একেবারেই হচ্ছে না অথবা সাংঘাতিকভাবে এর বৃদ্ধি কমে গেছে। যেমন সুন্দরি, গোলপাতা। শুষ্ক মৌসুমে নোনার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বৃদ্ধি পায়।’
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদরাজি বায়ুমন্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নেয়। এতে পরিবেশের দূষণ কমে। কার্বন ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তর করে লবণাক্ত পানির এই উদ্ভিদরাজি বেড়ে ওঠে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে ৩৪ প্রজাতির গাছ আছে। এর মধ্যে কেওড়াগাছ সর্বাধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড তার শিকড়, কান্ড, ডালপালা ও পাতায় আটকে রাখতে পারে। এক হেক্টর কেওড়াবন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে পারে। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গোড়ান তা ২৩ টন। গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষমতা কমতে থাকে।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখে সেইসাথে প্রতিবছর আরো ৩৮ লাখ টন যোগ হচ্ছে। এই বনের মৎস্যসম্পদের (মাছ ও চিংড়ি, কাঁকড়া, কুঁচে প্রভৃতি) ওপর এখনো বিপুল সংখ্যায় মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বিশেষত ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে সুন্দরবন মানুষের জীবন, সম্পদ ও জনপদকে রক্ষা করে চলেছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধসহ সাম্প্রতিককালে আঘাত হানা আম্ফান, ইয়াসেও সুন্দরবন বুক উচিয়ে রক্ষা করেছে। অবশ্য নদীগর্ভে অধিক হারে পলি জমছে। এতে নদীগুলোর গভীরতা কমে যাচ্ছে। এ কারণে ইয়াসে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রায় পুরো এলাকা তিন থেকে চার দিন ডুবে ছিল। এ সময় বনের মধ্যকার মিষ্টি পানির পুকুরগুলো নোনাক্রান্ত হয়। এতে প্রাণিকূল সুপেয় পানির সংকটে পড়ে। এ ছাড়া আরো দু’বার সুন্দরবনের ঘষিয়াখালি নদীতে তৈলবাহী ট্যাংকার ফেটে ট্যাংকারের সবতেল, মবিল নদীকে ভীষণভাবে দূষণ করে। প্রসঙ্গক্রমে ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মন্তব্য হচ্ছে, ‘প্রাকৃতিক কারণেই সুন্দরবনের নানা পরিবর্তন ঘটছে। দৃশ্যমানভাবে আমরা জানতে পারছি যে অনেক গাছ, প্রাণী, পাখি হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে সুন্দরবনের সামুদ্রিক পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমেছে। এই অতিরিক্ত লবণাক্ততাই সুন্দরবনের জন্য এখন মারাত্মক সমস্যা। তবে শতবছরেরও বেশি আগের ১৯০৩ সালের ডকুমেন্ট বলছে, এই অঞ্চলে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হচ্ছে সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে এর আয়তন ১০ হাজার ২৩০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ছয় হাজার ৩০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কাজেই প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য বিশেষ করে উপক‚লীয় মানুষের জীবন, জীবিকা, সম্পদ রক্ষার স্বার্থেই সুন্দরবনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ।
লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন