ভারতে দুই পুত্রের কাহিনী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম জন আরিয়ান খান, বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের ছেলে, যিনি একটি পার্টিতে মাদক সেবন করার অভিযোগে রোববার গ্রেফতার হয়েছেন। দ্বিতীয়জন আশিস মিশ্র, ভারতের জুনিয়র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে, যার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে হত্যার অভিযোগ আছে। জনাব খান ও মিশ্র দুজনেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, কিন্তু দুটি ঘটনায় কোনো যোগসূত্র নেই।
কিন্তু দুই যুবকের প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণ এবং আরিয়ান খানের ঘটনায় গণমাধ্যমের বিরাট আকর্ষণ তাতে অনেকের মনে সংবাদমাধ্যমের এজেন্ডা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ‘বলিউডকে কলঙ্কিত’ করার চেষ্টার অভিযোগ এনেছেন।
খান পরিবারের বাসস্থান মুম্বাই থেকে পর্যটকদের স্বর্গ হিসেবে পরিচিত গোয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া একটি প্রমোদতরী থেকে আরিয়ান খানকে ধরা হয়। ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) আরো বেশ কয়েকজনের সাথে জনাব খানকেও আটক করে। তাদের ‘অবৈধ মাদক বহন, সেবন ও বেচাকেনা’ সংক্রান্ত আইনে গ্রেফতার হয়।
২৩ বছর বয়সী আরিয়ান খানকে গতকাল পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জনাব খানের গ্রেফতার সংক্রান্ত কাগজে যে পরিমাণ মাদকের কথা বলা হয়েছে তাতে তাকে জামিন না দেয়ার কোন কারণ নেই।
তার আইনজীবী সাতিশ মানশিন্ডে জোরালোভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জামিন শুনানিতে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেন, আরিয়ান খানকে ‘জাহাজে ওঠার আগে দুইবার তল্লাশী করা হয়েছে’ এবং ‘সেখানে কোনো নিষিদ্ধ বস্তু মেলেনি’ এবং ‘তিনি যে মাদক সেবন করেছেন এমন কোনও প্রমাণ নেই’।
বিক্ষোভ, গাড়ি তুলে দেয়া ও মৃত্যু
দ্বিতীয় ঘটনাটিতে জড়িত আশিস মিশ্র, যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার সদস্য অজয় মিশ্রর ছেলে। উত্তর প্রদেশের লখিমপুর এলাকায় একদল কৃষকের ওপর একটা গাড়ির বহর থেকে গাড়ি তুলে দেয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
সব মিলিয়ে আটজন মারা গেছেন এ ঘটনাপ্রবাহে। কৃষকদের ইউনিয়ন বলছে, গাড়িচাপায় দুইজন বিক্ষোভকারী ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। আরো দু’জন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মারা গেছেন। এছাড়া বিক্ষোভকারীদের পিটুনীতে মারা গেছেন তিনজন বিজেপি কর্মী ও একজন গাড়িচালক।
প্রাথমিক খবরে বলা হয়, আশিস মিশ্র বলেছেন, উত্তেজিত কৃষকদের পিটুনীর হাত থেকে রেহাই পেতে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যান তিনি। পরে আবার তিনি বলেন, ঘটনার সময় তিনি গাড়িতেই ছিলেন না। তার বাবাও তার এ দাবিকে সমর্থন করেন। বিরোধী দল ও কৃষকদের সংগঠনগুলোর প্রতিবাদের পরে সোমবার সকালে পিতা ও পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে পুলিশ একটা তদন্ত শুরু করে।
উত্তর প্রদেশ পুলিশের একজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা ভিক্রাম সিং বলেছেন, ‘অভিযোগ দাখিল করতে পুলিশ যে অবহেলা দেখিয়েছে ও সময় নষ্ট করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য’।
তিনি বলেন, ‘লখিমপুরে প্রাণহানি হয়েছে যা অনেক বেশি শোকের, কিন্তু খানের গ্রেফতারের খবরই সব প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছে’।
মিডিয়া কভারেজ
গত রোববার দিনভর কিছু টিভি চ্যানেল খান পরিবারের কঠিন পরীক্ষা নিয়েছে। আরিয়ান খানকে পুলিশী হেফাজতে নেয়ার পুরো ঘটনার ছবি তোলা হয়েছে এবং ভিডিও করা হয়েছে। তার ‘অ্যারেস্ট মেমো’ টিভিতে দেখানো হয়েছে এবং হোয়াটস্যাপেও শেয়ার করা হয়েছে ব্যাপকভাবে।
জনাব খানের এ গ্রেফতারকে ‘আমোদ পার্টি থেকে গুরুত্বপূর্ণ গ্রেফতার’ বলে অভিহিত করেন একজন সংবাদ উপস্থাপক। আরেকজন উপস্থাপক দাবি করেন ‘বলিউডের সাথে মাদকের সংশ্লিষ্টতার’ অবসান হোক। এসব চ্যানেলে আলোচকরা আরিয়ান খানের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ ছাড়াই নানা দায় চাপান। একইসাথে শাহরুখ খান ও গৌরী খানের সন্তান প্রতিপালনের মান নিয়েও সমালোচনা করেন।
টুইটারে দিনভর আরিয়ান খানের নাম ট্রেন্ড করেছে, অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। #BollywoodDruggies ও #BollyDruggiesShamingNation শীর্ষক হ্যাশট্যাগও ছিল ট্রেন্ডিং।
কিন্তু লখিমপুরের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা বাদেও মিশ্রদের কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পর্যন্ত থানায় ডাকা হয়নি। টিভি চ্যানেলগুলোও ছিল এ ব্যাপারে নিরব।
নামকরা টেলিভিশন উপস্থাপকেরা মিশ্রর গ্রেফতার দাবি থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। কেউ কেউ এমনকি এসব মৃত্যু ও সহিংসতার জন্য কৃষকদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন (যে কৃষকেরা এক বছর ধরে ভারতের নতুন তিনটি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন)। সোমবার সকালে টুইটারে একমাত্র যে হ্যাশট্যাগটি ট্রেন্ড করছিল সেটির বিষয়বস্তু ছিল উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ইয়োগি আদিত্যনাথ ‘কৃষক ও বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করেছেন’।
‘তারকাপুত্র’ বনাম অচেনা মন্ত্রিপুত্র
সাবেক সাংবাদিক জন থমাস বলেন, মাদক পার্টি থেকে গ্রেফতারের ঘটনার খবর ছিল ‘সবার ওপরে’, কিন্তু এটা ‘আমাদের চটকদার ও ক্লিক প্রত্যাশি সাংবাদিকতায় কাক্সিক্ষত ঘটনা ছিল’। তিনি বলেন, ‘তারকাপুত্রের তারকাখ্যাতি নিয়ে টিভি ও সংবাদপ্রের ভোক্তাদের আগ্রহই এর পেছনে কারণ বলে অনুমিত’।
‘অন্যদিকে রাজনীতিবিদের ছেলে, যিনি দেশজুড়ে বলতে গেলে প্রায় অচেনা এবং যার পিতাও তেমন চেনাজানা কেউ নন, মোদি সরকারের একজন জুনিয়র মিনিস্টারকে কে চিনবে’?
পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বিক্রম সিং বলেছেন, এমন উপর্যুপরি কভারেজের পেছনে বলিউডকে কলঙ্কিত করার ‘একটা গোপন এজেন্ডা ও কুটিল পরিকল্পনা’ কাজ করেছে।
তিনি রিয়া চক্রবর্তীর ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেন। গতবছর তার প্রেমিক, বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃতদেহ মুম্বাইয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া যাওয়ার পর মিজ চক্রবর্তীকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগেন ভারতের কিছু হাই প্রোফাইল সাংবাদিক।
‘রিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছিল তার কোনো প্রমাণ ছিল না, কিন্তু এই ঘটনায় তার ভাবমর্যাদা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। আরিয়ান খানের অ্যারেস্ট মেমো দেখে বোঝা যায় মাদকের পরিমাণ ছিল সামান্যই, কিন্তু এতে পরিবারের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হবার জোগাড় হয়েছে’।
‘এটা জামিনযোগ্য অপরাধ। তাহলে এনসিবি কেন তার রিমান্ড চাইলো’? প্রশ্ন তোলেন মি. সিং। ‘অভিযুক্তের পরিচয়ও তাদের মিডিয়ার কাছে প্রকাশ করা উচিত হয়নি এবং তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করে রিপোর্ট প্রকাশ করতে দেয়াও উচিত হয়নি’।
তরুণদের মাদক গ্রহণের ঘটনা মি. সিংয়ের চোখে তার মতে ‘মানবিক বিপর্যয়’। এক্ষেত্রে তিনি কর্মকর্তাদের ‘সংবেদনশীল’ আচরণ করার আহ্বান জানান।
‘মাদক নির্মূল করা যাবে না। তাই মাদকের অপব্যবহার সামলাতে হবে মাদকাসক্ত দুর্ভাগাদের নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়ে পুনর্বাসন করার মাধ্যমে’। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
আরিয়ানসহ ৮ জন ১৪ দিনের জেল হেফাজতে
এদিকে আরিয়ান খান, আরবাজ মার্চেন্টসহ ছ’জনকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল মুম্বাইয়ের আদালত। কোর্টের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ মামলার পরবর্তী শুনানি এনডিপিএস আদালতে হবে। গতকাল শাহরুখ পুত্রসহ বাকি সাতজন অভিযুক্তকে এদিনই আদালতে তুলেছিল এনসিবি। সূত্রের খবর, অভিযুক্তদের আগামী ১১ অক্টোবর পর্যন্ত হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো। তবে শুনানির পর অবশেষে ধৃতদের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। জেল হেফাজত হওয়ার আগেই আরিয়ান খানের অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করা হয়। সূত্রের খবর, আজই ওই মামলার শুনানি হওয়ার কথা। শাহরুখ পুত্রের আইনজীবী সতীশ মানেশিন্ডে বলেন, ‘আমরা আরিয়ানের অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করেছি। আজ সকাল ১১টায় আরিয়ানের জামিনের মামলার শুনানি রয়েছে’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন