শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনোদন প্রতিদিন

ইনকিলাব বচ্চনও হতে পারত অমিতাভ বচ্চনের নাম!

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৯:৫৬ পিএম

কাহিনীটা অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে। কিন্তু এমনটা হতেই পারত যে তাকে আজ 'ইনকিলাব বচ্চন' বলে মানুষ চিনত। কারণ তার নাম যে দেয়াই হয়েছিল ইনকিলাব। অবশ্য সেটা তার বাবা মায়ের দেয়া নাম নয়, এক পারিবারিক বন্ধু পণ্ডিত অমরনাথ ঝা রেখেছিলেন সেই নাম।

ভারতে তখন এক অর্থে ইনকিলাব বা বিপ্লবই চলছিল। ভারত ছাড় আন্দোলনের কারণে ১৯৪২ এর সেই বছরটা গোটা দেশ তখন উত্তাল। সে বছরের ১১ অক্টোবর এলাহাবাদে হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় কবি হরিভনশ রাই বচ্চন আর তেজি বচ্চনের কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তান এল। সেদিনই তার অমিতাভ নামটাও ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

অমিতাভ বচ্চনের ওপরে সম্প্রতি প্রকাশিত বই 'অমিতাভ বচ্চন দা ফরএভার স্টার'-এর লেখক প্রদীপ চন্দ্রা বলছিলেন, "যেদিন অমিতাভ বচ্চনের জন্ম হল, সেদিনই তাদের বাড়িতে থাকতে এসেছিলেন হিন্দি ভাষার প্রখ্যাত কবি সুমিত্রানন্দন পন্থ। তিনি অন্য কারও বাড়িতে উঠেছিলেন। অমিতাভের বাবা হরিভনশ রাই বচ্চন দেখা করতে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে। তিনি পন্থকে বলেন যে 'এখানে আছেন কেন, আপনি আমাদের বাড়িতে চলুন।'

"পন্থ রাজি হয়ে গেলেন বচ্চন পরিবারের সঙ্গে থাকতে। সেদিনই শিশু সন্তান এসেছে বাড়িতে। সদ্যোজাত শিশুটিকে দেখার পরেই সুমিত্রানন্দন পন্থ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এর নাম তো অমিতাভ হওয়া উচিত।' আর পণ্ডিত অমরনাথ ঝা শিশুটির নাম রেখেছিলেন ইনকিলাব। কিন্তু সেই নাম বেশি দিন থাকে নি। বচ্চন পরিবার অমিতাভ নামটাকেই বেছে নিয়েছিলেন," বিবিসিকে বলছিলেন প্রদীপ চন্দ্রা।

যদি কবি সুমিত্রানন্দন সেদিন এলাহাবাদে না যেতেন, বা যদি বচ্চন পরিবারের সদ্যোজাত শিশুটিকে না দেখতেন, তাহলে হয়ত অমিতাভ বচ্চন নয়, ইনকিলাব বচ্চনকে চিনত সবাই। অথবা সেটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ওই নামটা পছন্দ না হলে অন্য কোনও নামও হতে পারত মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চনের। নাম বদল করার ঘটনা তো মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বহু রয়েছে।

নৈনিতালের শেরউড স্কুলে পড়াশোনার পরে অমিতাভ দিল্লি চলে আসেন, ভর্তি হন কিরোরিমল কলেজে। সেখানেই নাটক করার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কলেজের ড্রামা সোসাইটির প্রধান ফ্র্যাঙ্ক ঠাকুরদাস অমিতাভ বচ্চনের সেই গুরুগম্ভীর গলার স্বরে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। একদিনের ঘটনা, সেই সময়ের নামকরা থিয়েটার অভিনেতা প্রতাপ শর্মার ভাইকে একটা নাটকের প্রধান চরিত্রের জন্য বাছা হয়েছিল। কোনও একটা ব্যক্তিগত কাজের জন্য শেষ মুহূর্তে তিনি নাটকে অভিনয় করতে অপারগ বলে জানান।

ফ্র্যাঙ্ক ঠাকুরদাসের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। প্রধান চরিত্রটা তাহলে কাকে দিয়ে করাবেন? অমিতাভ বচ্চন এগিয়ে গিয়েছিলেন ওই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। রাজী হয়ে গেলেন ঠাকুরদাস। আর সুযোগটা কাজে লাগিয়ে অমিতাভ বচ্চন অসাধারণ অভিনয় করলেন। পরে, মিরান্ডা হাউস কলেজের একটা নাটক 'রেপ অফ দা বেল্ট'এও অভিনয় করেন। ওই নাটকের পরে তোলা একটি ছবি অমিতাভ বচ্চন ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন ২০১৩ সালে। "মিরান্ডা হাউজ মেয়েদের কলেজ। সেখানে 'রেপ অফ দা বেল্ট' নাটকটা বার্ষিক অনুষ্ঠানে করার কথা। কিন্তু ছেলেও লাগবে নাটকে, তাই অন্যান্য কলেজ থেকে তিনজন শিক্ষার্থীকে ওই নাটকে অভিনয়ের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল।"

সেই সময়ে মিরান্ডা হাউসের ছাত্রী ছিলেন মুম্বাইয়ের নাট্যজগতের প্রথিতযশা অভিনেত্রী ডলি ঠাকোর। তিনি স্মৃতিচারণে বলছেন, "সেই সময়ে অমিতাভ বচ্চন চুপচাপ এক কোনে বসে থাকতেন। খুব লাজুক ছিলেন। তার ছোটভাই অজিতাভ দেখতে ওর থেকেও সুন্দর ছিল।"

বি এ পাশ করার পরে অমিতাভ বচ্চন কলকাতায় বার্ডস এন্ড কোম্পানিতে চাকরী নেন। সেটা ছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশক। বার্ডস কোম্পানির কয়লা খনি, চটকল, কাগজ কল সহ বিভিন্ন ব্যবসা ছিল। কলকাতার ডালহৌসি এলাকায় মহাকরণের কাছেই ছিল ওই কোম্পানির সদর দপ্তর। ১৯৭৪ সালে ওই কোম্পানি সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। তাদের হাতে রয়ে যায় শুধু চটকলের ব্যবসা। ২০১১ সালে অমিতাভ বচ্চন টুইট করেছিলেন পুরানো সেই দিনের কথা মনে করে।

"কলকাতা.. তখনকার ক্যালকাটা... প্রথম চাকরী বার্ড এন্ড কোং-এ.. বেতন ৫০০ টাকা প্রতিমাসে, কেটে কুটে ৪৬০ টাকা"। দুবছর পরে আরেকটা সংস্থা ব্ল্যাকার এন্ড কোম্পানিতে যোগ দেন তিনি। সেখানে তার বেতন তো বেড়েছিলই, সঙ্গে অফিস যাতায়াতের জন্য একটা মরিস মাইনর গাড়িও দেওয়া হয়েছিল।

অভিনয়ের প্রতি অমিতাভ বচ্চনের টান দেখে ছোট ভাই অজিতাভ বচ্চন তার একটা ছবি পাঠিয়ে দেন 'ফিল্ম ফেয়ার মাধুরী ট্যালেন্ট কন্টেস্টে'। প্রদীপ চন্দ্রার কথায়, "অমিতাভ বচ্চন যখন ওই প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠিয়েছিলেন, তখন তো তিনি আর অমিতাভ বচ্চন ছিলেন না। ও ধরণের প্রতিযোগিতায় যেরকম কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ে, তিনিও সেরকমই আবেদন করেছিলেন। এটা তার সৌভাগ্য বলুন বা দুর্ভাগ্য, তিনি ওই প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হন নি। তবে এটা বোধহয় তার জন্য ভালই হয়েছিল।"

সবাই বাতিল করছিলেন অমিতাভকে

ফিল্মের জগতে অমিতাভ বচ্চনের প্রবেশ ঘটেছিল নার্গিস ও সুনীল দাতের সঙ্গে তেজি বচ্চনের বন্ধুত্বের মাধ্যমে। কিন্তু তার আগে ১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত ফিল্ম পরিচালক শ্রাভন কুমার টাকের সঙ্গে তেজি বচ্চনের দেখা হয়েছিল দিল্লিতে। মিসেস বচ্চন তাকে বলেছিলেন যে তার ছেলে ফিল্মে কাজ করতে আগ্রহী। টাক সেই সময়ে মির্জা গালিবের ওপরে একটা ছবি করার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি অমিতাভ বচ্চনকে মির্জা গালিবের চরিত্রটা দেওয়ার কথা ভেবে ফেলেছিলেন। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠরা তাকে বোঝান যে গালিবের চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন মানানসই হবেন না, কারণ তিনি ভীষণ লম্বা, আর গালিব বেশ বেঁটেই ছিলেন।

এরপরে সুনীল দাতের সুপারিশে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা বি আর চোপরা অমিতাভ বচ্চনের স্ক্রিন টেস্ট নিতে রাজী হলেন। কিন্তু তারপরে চোপরার কাছ থেকে আর কোনও সাড়া পান নি তিনি। প্রদীপ চন্দ্রার কথায়, "অমিতাভ বচ্চন সব জায়গা থেকেই রিজেক্টেড হয়ে যাচ্ছিলেন। আকাশবাণী তাকে পছন্দ করে নি আগে। তারপরে তিনি মুম্বাই গেলেন। সুনীল দাতের সঙ্গে বি আর চোপড়ার ভাল সম্পর্ক ছিল। দাত বি আর চোপড়ার ছবিতে নিয়মিত কাজ করতেন। দাত সুপারিশ করেছিলেন অমিতাভ বচ্চনের জন্য। তিনি গিয়েছিলেন চোপড়ার সঙ্গে দেখা করতে।

"চোপরা দেখা করলেন ঠিকই, কিন্তু বিশেষ কোনও ইন্টারেস্ট দেখান নি বচ্চনের ব্যাপারে। তবে একটা কাজ তিনি করেছিলেন। তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন এই ছেলেটির স্ক্রিন টেস্ট নিয়ে নাও। সেই বন্ধুটি ছিলেন ফিল্ম প্রোডিউসার তারাচাঁদ বরজাতিয়া," জানাচ্ছিলেন প্রদীপ চন্দ্রা। তার কথায়, "তিনি তো অমিতাভ বচ্চনকে দেখেই বাতিল করে দিলেন। বললেন, আরে আপনাকে তো কবি কবি দেখতে। বচ্চন তো কুর্তা পাজামা পরতেন। তা দেখে বরজাতিয়া বললেন, আপনি এইসব ফিল্মের জগতে কেন আসছেন, কবিতা লিখুন বাবার মতো। এরকম আরও অনেকেই বাতিল করেছেন অমিতাভ বচ্চনকে।"

প্রথম সিনেমায় ৫ হাজার টাকা

তাকে প্রথম ফিল্মে নেন নামকরা পরিচালক খ্বাজা আহমেদ আব্বাস। পরিচালক টিনু আনন্দের বন্ধু নীনা সিং আনন্দকে অনুরোধ করেছিলেন যে অমিতাভ বচ্চনের কিছু ছবি যেন তিনি আব্বাসকে দেখান। "আব্বাস সাহেব বললেন, ডাকো একে। তো দুই ভাই অমিতাভ আর অজিতাভ কলকাতা থেকে মুম্বাই গেলেন দেখা করতে। প্রথমে তারা টিনু আনন্দের সঙ্গে দেখা করেন। বচ্চন আমাকে নিজের মুখে যেটা বলেছেন, সেখানে গিয়ে তিনি বলেন যে বাথরুমে যেতে পারি একটু? ভেতর থেকে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসার পরে টিনু আনন্দ তাকে আব্বাস সাহেবের কাছে নিয়ে যান। তার পছন্দ হয়ে গেল। অমিতাভ বেরিয়ে যাওয়ার পরে আব্বাস সাহেব বলেন একে বলে দাও যে ছবিতে নেব, কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারব। কিন্তু এটা বলতে পারব না যে ছবিটা তৈরি হতে পাঁচ মাস লাগবে না একবছর!", বলছিলেন প্রদীপ চন্দ্রা।

আব্বাস আর অমিতাভ বচ্চনের সেই সাক্ষাতকারের কথা বিবিসিকে শুনিয়েছিলেন আব্বাসের ভাতিজি সৈয়দা সৈয়াদেন হামীদ। "লম্বা একটা ছেলে এসেছিল। আব্বাস সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নাম কি? সে জবাব দিয়েছিল যে তার নাম অমিতাভ। আব্বাস সাহেব জানতে চেয়েছিলেন পুরো নাম কি? ও বলেছিল পদবীটা। সেটা শুনেই আব্বাস সাহেব বলেছিলেন তুমি আমার বন্ধু হরিভনশ রাই বচ্চনের ছেলে না কি? তার জবাব ছিল, হ্যাঁ। তিনি তখন জানতে চান যে বাবার মত নিয়ে এসেছ তো? সে জানিয়েছিল, হ্যাঁ বাবা মা জানেন আমার এখানে আসার কথা। তিনি মানতে চান নি, বলেছিলেন, আমি তাকে চিঠি লিখব। হরিভনশ রাই বচ্চনকে চিঠি লিখলেন আব্বাস সাহেব যে আপনি অনুমতি দিলে তবেই আপনার ছেলেকে ছবিতে নেব। হরিভনশজি টেলিগ্রাম করে জবাব দিয়েছিলেন যে আপনার সঙ্গে যদি ফিল্মে কাজ করে তাহলে আমার আপত্তি নেই," বিবিসিকে জানিয়েছিলেন মিজ হামীদ।

তার কথায়, "অমিতাভকে আব্বাস সাহেব জানতে চেয়েছিলেন তুমি কী কাজ করো? তার জবাব ছিল পনেরো শো টাকা মাসিক বেতনে কলকাতায় একটা চাকরী করত। আব্বাস সাহেব 'করত' শব্দটা শুনে অবাক হয়ে বলেছিলেন করতে মানে এখন আর চাকরী করো না? অমিতাভ বলেছিল যে সে চাকরী ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে। সেটা শুনে তিনি বলেছিলেন আরে তুমি চাকরী ছেড়ে চলে এসেছ, কিন্তু আমি তো তোমাকে পুরো সিনেমাটার জন্য পাঁচ হাজারের বেশি দিতে পারব না। আমার কাছে এর থেকে বেশি নেই।" "অমিতাভ বলেছিল মাম্মুজান, আপনি যা দেবেন তাতেই রাজী," বিবিসিকে জানিয়েছিলেন সৈয়দা সৈয়াদেন হামীদ।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এ অমিতাভ তার প্রথম ছবি 'সাত হিন্দুস্তানি'র জন্য চুক্তি সই করেন। প্রথম ছবির জন্যই অমিতাভ জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন। খ্বজা আহমেদ আব্বাস খুব কম বাজেটে ছবি করতেন, কিন্তু ছবি করার সময়ে খুশি হলে তার সহকর্মীদের মধ্যে কোনও একজনকে ৫০ টাকা দিয়ে বলতেন যাও মজা করো। একবার অমিতাভ বচ্চনও সেরকম একটা ৫০ টাকা পেয়েছিলেন। টাকা পেয়েই তিন বন্ধু - অমিতাভ বচ্চন, জালাল আগা আর আনোয়ার আলি একটা স্মরণীয় সন্ধ্যা কাটানোর প্ল্যান করলেন।

তিনজনে জমিয়ে মদ্যপান করলেন। পরের দিন আনোয়ার আলি বচ্চনকে পরামর্শ দিলেন 'যতদিন ইন্ডাস্ট্রিতে তোমার নাম না হচ্ছে, ততদিন মদ ছোঁবে না'। সেদিনই অমিতাভ বচ্চন মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। সারা জীবন তিনি এই প্রতিজ্ঞা পালন করে এসেছেন। তবে একবার মাত্র তিনি সামান্য মদ্যপান করেছিলেন, ছোটভাই অজিতাভের বিয়ের দিনে।

'সাত হিন্দুস্তানি'র পরে অমিতাভ বচ্চনের ভাগ্য তার সহায় হচ্ছিল না। পর পর দশটা ছবি বক্স অফিসে মার খেল। ১৯৭১ সালে তার ছবি 'পরওয়ানা' রিলিজ করল, যাতে নভিন নিশ্চল হিরো ছিলেন আর অমিতাভ বচ্চনের ছিল একটা খারাপ মানুষের চরিত্র। এর মধ্যে সুনীল দাত তার ছবি 'রেশমা অউর শেরা'তে কাজের সুযোগ দিলেন তাকে। ঘটনাচক্রে ওই ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রটা ছিল এক বোবা মানুষের।

ওই ছবিটা নিয়ে হরিভনশ রাই বচ্চন পরে নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, "ওই ছবিটাই অমিতাভের অভিনয় ক্ষমতার আসল পরীক্ষা ছিল। কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে চরিত্রটা দর্শকদের কাছে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছিল তাকে।" একবার খ্বজা আহমেদ আব্বাসের সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন হৃষীকেশ মুখার্জীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে মুখার্জী তার পরবর্তী ছবি 'আনন্দ'এর জন্য একজন অভিনেতা খুঁজছিলেন। অমিতাভ বচ্চনকে দেখেই তিনি বুঝলেন যে তিনি তার 'বাবুমশায়' খুঁজে পেয়েছেন।

এর আগে ওই চরিত্রের জন্য তিনি উত্তমকুমারকে নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। পরে, এক সাক্ষাতকারে হৃষীকেশ মুখার্জী বলেছিলেন, "অমিতাভের গম্ভীর গলার আওয়াজ আর তার চাহনির জন্য আমি তাকে বেছেছিলাম। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে ওই ছবিতে অমিতাভ রাজেশ খান্নার থেকেও ভাল অভিনয় করেছিল।" অমিতাভ বচ্চনের গোড়ার দিকের ছবিগুলো না চললেও তার অভিনয় কিন্তু সবাইকে আকৃষ্ট করে ফেলেছিল।

প্রদীপ চন্দ্রা বলছিলেন, "অমিতাভ বচ্চনকে মানুষ তো ভালবেসে ফেলেছিল। তাদের ভালবাসা যদি না থাকত, তাহলে তো তিনি ১৩টা ছবিতে কাজ পেতেন না। তিনটে কি চারটে ছবির পরেই তাকে ফিরে যেতে হত। তাই এটা স্পষ্ট ১৩টা ছবিতে কাজ যখন পেয়েছিলেন, হতে পারে ছবিগুলো চলে নি, কিন্তু তার অর্থ মানুষ তার অভিনয় পছন্দ করছিলেন। তিনি শুধু একটা ভাল ব্রেক পাচ্ছিলেন না।

১৯৭৩ সালে সুপারহিট

"জাভেদ আখতার আমাকে বলেছিলেন প্রকাশ মেহেরা যখন 'জঞ্জির' বানাচ্ছেন, তখন ধর্মেন্দ্র, রাজকুমার আর দেবানন্দ কোনও না কোনও অজুহাত দেখিয়ে ছবিতে কাজ করতে চাইলেন না। অমিতাভের কথা জাভেদ আখতারের মনে আসে। তিনি অমিতাভের যে সব ছবি চলে নি, সেগুলো মন দিয়ে দেখলেন। তার মনে হল খুবই শক্তিশালী অভিনেতা, কিন্তু তার ছবিগুলো চলছে না কেন!", বলছিলেন চন্দ্রা। 'জঞ্জির' - এর অন্যতম কাহিনীকার ছিলেন জাভেদ আখতার। আরেকজন হলেন সেলিম খান।

তার কথায়, "কোনোভাবে ফোন নম্বর যোগাড় করে একদিন জাভেদ আখতার অমিতাভকে ফোন করেন। একটা ছবির গল্প শোনার জন্য অনুরোধ করেন অমিতাভকে। তার হাতে সম্ভবত সেরকম কাজ ছিল না তখন, বললেন, আজকেই চলে আসুন। গল্পটা শোনানোর আগে জাভেদ আখতার তাকে বলেন একটাই অনুরোধ এই ছবিটা করতে আপনি আপত্তি করবেন না। গল্পটা শোনার পরে তার খুব পছন্দ হয়ে যায়, কিন্তু আবার সন্দেহ দানা বাধে যে তিনি চরিত্রটা করতে পারবেন তো আদৌ? জাভেদ সাব কে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন অমিতাভ যে তার কি সত্যিই মনে হয় যে তিনি চরিত্রটা ঠিক করে করতে পারবেন?

"জবাবে জাভেদ আখতার বলেছিলেন এই চরিত্রটা শুধু আপনিই করতে পারবেন । সেলিম খানকে জাভেদ আখতার জানালেন যে অমিতাভ রাজী হয়েছেন, প্রকাশ মেহেরার কাছে গেলেন দুজনে। পরের দিন প্রকাশ মেহেরাকে নিয়ে জাভেদ আখতার আর সেলিম খান গেলেন রূপতারা স্টুডিওতে। সেখানে অমিতাভ বচ্চন, জিতেন্দ্র আর হেমা মালিনী শুটিং করছিলেন। সেখানেই কথা পাকা হয়ে গেল আর চুক্তি সই হয়ে গেল," বলছিলেন প্রদীপ চন্দ্রা।

১৯৭৩ সালে রিলিজ হওয়া 'জঞ্জির' সুপার হিট হয়ে গেল। ফিল্ম ফেয়ার পুরষ্কারে নয়টা আলাদা ক্যাটেগরিতে নমিনেশন পেল ছবিটা । মান্না দের গাওয়া, প্রাণ আর অমিতাভ বচ্চনের লিপে গান 'ইয়ারি হ্যায় ইমান মেরা ইয়ার মেরি জিন্দেগি' সেবছরের সবথেকে জনপ্রিয় গান হিসাবে পরিগণিত হল। এই ছবিটাই একজন অভিনেতাকে সুপারস্টার বানিয়ে দিল। এখান থেকেই তার 'অ্যাংরি ইয়াং ম্যান' ভাবমূর্তির শুরু। সারা দেশে শুরু হল তাকে নিয়ে উন্মাদনা।

তবে অমিতাভ বচ্চন নিজে মনে করেন যে তার ওই 'অ্যাংরি ইয়াং ম্যান' ভাবমূর্তিটা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ এই রিলিজ হওয়া হৃষীকেশ মুখার্জীর ছবি ‘নিমকহারাম' থেকে। হৃষীকেশ মুখার্জী বলতেন 'আনন্দ' ছবিটা করার সময়েই তিনি অমিতাভ বচ্চনের শক্তিশালী 'অন স্ক্রিন প্রেজেন্স' টা টের পেয়েছিলেন। সতার কথায়, "আমি বুঝতে পারছিলাম গম্ভীর কণ্ঠস্বর আর চোখের চাহনি দিয়েই কোনও চরিত্রকে শক্তিশালী করে তোলার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। সেইজন্যই আমি 'নমকহারাম' ছবিতে তার চরিত্রটাকে আমি 'অ্যাংরি ইয়াং ম্যান'-এর রূপ দিয়েছিলাম।" সেই 'অ্যাংরি ইয়াং ম্যান' এখন ৮০ পেরিয়েছেন। সূত্র: বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন