কিশোর অপরাধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। সকল সমাজেই রয়েছে এর অনিবার্য উপস্থিতি। তবে প্রকৃতি ও মাত্রাগত দিক থেকে তা বিচিত্র। প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা স্বভাব-ধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতা-মাতা ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশ তাকে ইসলাম থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়ে অন্যত্র নিয়ে যায়। ফলে শিশু-কিশোররা মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরাধ প্রবণতার দিকে ধাবিত হয়। সারাবিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে কিশোর অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে পরিণত হতে পারে। যা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামে কিশোর অপরাধের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। সুস্থ দেশ-জাতি ও শান্তিময় বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে আলোচ্য প্রবন্ধে কিশোর অপরাধের কারণগুলো অনুসন্ধান করে ইসলামের আলোকে এর প্রতিকারের উপায় তুলে ধরা হয়েছে।
শিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির উপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি। শিশু-কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের একটি অংশ কোন কারণে অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চরম হুমকি ও সুস্থ সমাজ জীবনের প্রতিবন্ধক হোক তা কারো কাম্য নয়। এজন্যই ইসলাম শিশু-কিশোরদের সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে এবং অপরাধমুক্ত জীবন-যাপনের উপস্থাপন করেছে সর্বজননীন ও কল্যাণকর নীতিমালা। যা বাস্তবে কার্যকর করতে পারলে পরিবার পেতে পারে কাক্সিক্ষত প্রশান্তি এবং দেশ ও জাতি লাভ করতে পারে অমূল্য সম্পদ।
কিশোর অপরাধ পরিচিতি : কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির ইংরেজী হলো Juvenile Delinquency। আর Delinquency ল্যাটিন শব্দ Delinquer থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ to omit বাদ দেয়া, বর্জন করা, উপেক্ষা করা ইত্যাদি। রোমানরা কোন ব্যক্তির উপর আরোপিত কর্ম অথবা কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা বুঝাতে উবষরহয়ঁবহপু শব্দটি ব্যবহার করত। ÒThe term æDelinquency” has been derived from the Latin word Delinquer which means æto omit”, The Romans used the term to refer to the failure of a person to perform the assigned task or duty. `ª: Dr. N.V. Pranjape, Criminology and Penology, Allahbad: Central Law Publications, 2005, p. 486”. ১৪৮৪ সালে উইলিয়াম কক্সসন সর্বপ্রথম Delinquent পরিভাষাটিকে দোষী ব্যক্তির প্রচলিত অপরাধ বর্ণনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়াও ১৬০৫ সালে ইংরেজ কবি সেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক Macbeth এ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। Ibid”.
কিশোর অপরাধ পরিভাষা আলোচনার পূর্বে শব্দ দু’টিকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করলে এর প্রতিপাদ্য বিষয় সহজেই অনুমেয় হবে। সাধারণত কিশোর বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তথা বাল্য ও যৌবনের মধ্যবর্তী বয়সের ছেলে-মেয়েদের বুঝায়। ‘শৈলেন্দ্র বিম্বাস, সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, কলিকাতা: সাহিত্য সংসদ, ২০০০ খ্রি., ২৪তম সংস্করণ, পৃ. ১৫২’। তবে কৈশোর কালের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও ইসলামী আইনে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত আইনে দেশ ও সমাজভেদে নির্দি’ বয়সের ছেলে মেয়েরা কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত। যেমন বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীর বয়স সীমা হলো ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত। ‘পান্না রানী রায়, অপরাধ বিজ্ঞান, ঢাকা: উপমা প্রকাশন, ২০১৩ খ্রি., পৃ. ১৭৪’। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত কিশোর অপরাধীর বয়সসীমা নিচের সারণীতে তুলে ধরা হলো: ‘আব্দুল হাকিম সরকার, অপরাধ বিজ্ঞান তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, ঢাকা : কল্লোল প্রকাশনী, ২০০৫ খ্রি., পৃ. ১৬৪’।
মায়ানমার ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, শ্রীলংকা ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, ভারত ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, পাকিস্তান ৭ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত, ফিলিপাইন ৯ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, থাইল্যান্ড ৭ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত, জাপান ১৪ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত, ইংল্যান্ড ৮ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত, ফ্রান্স ১৩ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, পোল্যান ্ড ১৩ াথেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, অস্ট্রিয়া ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত, জার্মানী ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত।
মহান আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অসীম রহমতে মানব সন্তান শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়কাল পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, পূর্ণাকৃতিবিশি’ ও অপূর্ণাকৃতিবিশি’ মাংসপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্য। আর আমি এক নির্দি’ কালের জন্য মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি; তারপর তোমরা যেন যৌবনে পদার্পণ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌঁছানো হয়, সে যেন জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে স্বজ্ঞান থাকে না। ‘আল-কুরআন, ২২; ৫’।
মানব জীবনের বিবর্তিত স্তরগুলোকে আরবী অভিধানে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ‘মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন সন্তানকে জানীন ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে সাতদিন বয়সের সন্তানকে সাদীগ, দুগ্ধপানকারীকে রাযী দুধ ছাড়ানো সন্তানকে ফাতীম, নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারা সন্তানকে দারিজ, দুধের দাঁত পড়া সন্তানকে মাছগুর, দাঁত পড়ার পর নতুন দাঁত উঠা সন্তানকে মুছছাগির, দশ বছর অতিক্রমকারীকে মুতার’আরি’, ভাল-মন্দের পার্থক্য নিরূপনকারী স্বপ্নদোষের নিকটবর্তী মুরাহিক/ইয়াফি, স্বপ্নদোষ হলে তাকে হাযাওয়ার, উপর্যুক্ত সকল অবস্থাকে বলা হয় গোলাম, গোঁফ কালো হলে তাকে বাকল, ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছরের মধ্য বয়সের লোককে শাববুন, ষাট বছর বয়সে উপনীত হলে কাহলুন এবং ষাট বছরের বয়সের পর সময়কে হারিম বলে। দ্র: আবু মানছুর আছ-ছা’লাবী, ফিকহুল লুগাহ, আল-মাকতাবাতুশ শামিলাহ ২য় সংস্করণ, খ. ১, পৃ. ১৭’। ইসলামী আইনবিদগণ কিশোর বলতে ঐ ছেলেদের বুঝিয়েছেন যাদের ইহতিলাম’। ‘ইহ্তিলাম: ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় উত্তেজনার সঙ্গে দ্রুতবেগে পুরুষ বা নারীর বীর্য নিসৃত হওয়াকে ইহতিলাম বলা হয়। দ্র: সা’দী আবু জীব, আল-কামূসুল ফিকহী, করাচী: ইদারাতুল কুরআন ওয়াল ‘উলুমিল ইসলামী, ১৩৯৭ হি. পৃ. ১০১’। বা স্বপ্নদোষ শুরু হয়নি এবং কিশোরী বলতে যাদের হায়েয। ‘হায়েয শব্দের অর্থ প্রবাহ বা স্রাব। প্রাপ্ত বয়স্কা নারীর জরায়ু থেকে রোগব্যাধি ব্যতীত প্রতি মাসে কয়েকদিন যে রক্ত নির্গত হয় তাকেই হায়েয বলে। দ্র: সা’দী আবু জীব, আল-কামুসুল ফিক্হী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭’। বা মাসিক ঋতুস্রাব হয়নি এমন মেয়েদেরকেই বুঝিয়েছেন। ‘আলা-উদ্দীন আবু বকর ইবন মাস’উদ আল-কাসানী, বাদা’ইউস সানাঈ’, করাচী: আদব মানযিল, ১৪০০ হি., খ. ৭, পৃ. ১৭২; মুহাম্মদ ইবন ইদরীস আশ-শাফি’ঈ, আল-উম্ম, মিসর; কিতাবুশ শা’আব, তা.বি,. খ. ৩, পৃ. ১৯১; আল-হাত্তাব মুহাম্মদ আত্-তারাবিলসী, মাওয়াহিবুল জালীল, লিবিয়িা: মাকতাবাতুন নাজাহ, তা.বি., খ. ৫ পৃ. ৫৭-৫৯; আহমদ ইবন আলী ইবন হাজার আল-‘আস্কালানী, ফাতহুল বারী, বৈরূত; দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪১০হি., খ. ৫, পৃ. ৩৪৭’। ইসলাম কৈশোর কালেল সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দি’ বয়সের উল্লেখ না করে বিশ্বজনীন ও বাস্তবসম্মত নীতি হিসেবে বয়ঃপ্রাপ্তিকে চুড়ান্ত সীমা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বালিগ বা বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণ হিসেবে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সুস্প’ভাবে প্রকাশিত হলে তারা কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত হবে না; বরং বয়ঃপ্রাপ্ত বলে গণ্য হবে। ছেলে ও মেয়েদের বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণগুলো হলো ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় ইহতিলাম বা বীর্যপাত হওয়া। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তোমাদের সন্তানেরা স্বপ্নদোষ ‘আয়াতে শব্দটি ‘ইহতিলাম’ শব্দ থেকে উদ্ভূত ক্রিয়াবিশেষ্য। এর অর্থ স্বপ্নদোষ। (ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব, বৈরূত; দারু সাদির, ১ম সংস্করণ, খ. ১২, পৃ. ১৪৫)’ হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছলে অর্থাৎ বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তারাও যেন অনুমতি প্রার্থনা করে যেমন অনুমতি প্রার্থনা করে থাকে তাদের বয়োজ্যেষ্ঠগণ। ‘আল-কুরআন, ২৪ : ৫৯’। এছাড়াও মেয়েদের হায়েয বা মাসিক ঋতুস্রাব ও গর্ভবর্তী হওয়ার মাধ্যমে বয়ঃপ্রাপ্তি প্রমাণিত হতে পারে। ‘আল-হুসায়ন ইবন মাস’উদ আল-বাগাবী, মা’আলিমুত তানযীল, বৈরূত: দারুল ফিকর, ১৪০৫ হি., খ. ২, পৃ. ১২’।
উপর্যুক্ত লক্ষণগুলোর কোনটিই যদি কারো মধ্যে প্রকাশিত না হয়, সে ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণের মাধ্যমে বালিগ বা বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত করা যায়। তবে ইসলামী আইনবিদগণ কিশোর-কিশোরীর বয়সের চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম আবু হানীফা রহ. ও মালিকী আইনবিদদের মতানুযায়ী, যে ছেলের ইহতিলাম বা বীর্যপাত হয়নি, তার আঠার বছর পূর্ণ বা হওয়া পর্যন্ত সে কিশোর হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যে মেয়ের ইহতিলাম বা বীর্যপাত হয়নি, তার সতের বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কিশোরী বলে গণ্য করা হবে। ‘আল-কাসানী, বাদাই’উস সানাঈ’, প্রাগুক্ত, খ. ৭, পৃ. ১৭২, ইবন হাজার ‘আল-আস্কালানী, ফাতহুল বারী, প্রাগুক্ত, খ. ৫, পৃ. ৩৪৭, সায়্যিদ সাবিক, ফিকহুস সুন্নাহ, আল-কাহেরা: দারুল ফাত্হ, ১৪২০ হি., খ. ৩, পৃ. ২৮২; মুহাম্মদ আবু-যাহরাহ, আল-জারীমাহ, আল-কাহেরা; দারুল ফিকর আল-‘আরাবী, ১৯৯৮ খ্রি., পৃ. ৩৩৭’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন