উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে, তবে এই শিক্ষার সুফল কি সমাজ পাচ্ছে? শিক্ষার হার বাড়লেও সমাজে বাড়ছে বিশৃংখলা, কলহ, অশ্লীলতাসহ নানা অপরাধ প্রবণতা। সমাজ ক্রমশ হয়ে উঠছে অস্থির। কেন এমন হচ্ছে? এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশের কোমলমতি শিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি। ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কি সঠিক কর্মপন্থা ও নীতি নিরূপণ করতে পারছে? সামাজিক শৃংখলা আর মূল্যবোধ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দীনতা প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো রয়েছে তথাকথিত ডিজিটাল তত্ত¡ এবং অবাধ আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন। ফলে অধিকাংশ শিশু, কিশোর-কিশোরীর মধ্যে সুকুমার বৃত্তির চর্চা দূরের কথা প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষাও অনুপস্থিত।
উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে তাদের মধ্যে বখাটেপনা এবং নিত্য-নতুন অপরাধ প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, বস্তির প্রসার ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যৌথ পরিবার প্রথার বিলুপ্ত, যথাযথ অভিভাবকত্ব না থাকা এবং সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় অপরাধ এবং বখাটেপনার সৃষ্টি করছে। ছেলেমেয়ে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাওয়া এবং বখে যাওয়ার পেছনে অভিভাবকরা অনেকাংশে দায়ী। তাদের উদাসীনতা এবং আস্কারাতেই সন্তান বখাটে হয়ে যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন মোতাবেক, দেশের বিভিন্ন স্থানে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্ধ, রাজনৈতিক গ্রæপিং এবং প্রতিহিংসার কারণে কিশোররা হামলা, নির্যাতন, হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই প্রভৃতি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন এবং পরিবারের শান্তি-স্বস্তি বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও সমাজে নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বিশেষত সা¤প্রতিককালে কিশোর অপরাধ একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা দল বাঁধছে এবং এক দল অন্য দলের সঙ্গে দ্বন্ধে জড়াচ্ছে। খুনের মতো ঘটনা ঘটাতে দ্বিধা করছে না। তেরো-চৌদ্দ থেকে ষোলো-সতেরো বছরের কিশোররা এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আইনের বিধান মতে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। আবার শিশুর প্রতি অনাকাক্সিক্ষত আচরণ ক্রমান্বয়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে সহায়ক হচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোররা নানারকম খারাপ আচরণ কিংবা দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে থাকে। যেমন স্কুলে কোনো ছেলেকে কেউ মারধর বা র্যাগিং করলে শিশুর মননে ক্ষোভের জন্ম নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষেরই উচিত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।
পরিবারেরও এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ে তথা কিশোর-কিশোরীদের চলাফেরা, আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা, লিঙ্গভেদে পোশাকের তারতম্য, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ে অভিভাবকমহল সচেতন না হওয়ায় তারা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। সন্তান কোথায় যায়, কী করে, সময়মতো ক্লাসে গেল কিনা, ক্লাস শেষে সময়মতো বাসায় ফিরল কিনা, আবার স্কুলে গেল ঠিক কিন্তু মিথ্যা কোনো কারণ দেখিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে গেল কিনা, কাদের সঙ্গে মিশছে, আড্ডা দিচ্ছে এসব খোঁজ-খবর রাখা দরকার। নৈতিক মূল্যবোধের ধ্বংসাত্মক চিত্র রোধে কর্মসূচি গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন। নিশ্চিত অধপতন ঠেকাতে সন্তানদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সমানভাবে দেয়া প্রয়োজন। তা হতে হবে ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করে।
তাছাড়া পাঠ্য বইয়ের বাইরেও শিক্ষামূলক কাহিনী পড়ায় আগ্রহী করে তোলা অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর জীবনকে কোনো আদর্শের লক্ষ্যে পরিচালিত করে তার চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করা। সত্য বলা, কথা দিয়ে কথা রাখা, মানুষ ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতাবোধ, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, শান্তি, মানবাধিকার, পারস্পরিক অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের মানসিকতা ও অভ্যাস গড়ে তোলা, সামাজিক কল্যাণমূলক ও দেশের মানোন্নয়নমূলক মানবীয় গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করে নেতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া। একটি শিশুর প্রাথমিক নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার গুণাবলি তার পরিবারের মাধ্যমেই শুরু হয়। পরিবারের, বিশেষ করে মায়ের কাছ থেকেই সে পায় বিশেষ নৈতিক শিক্ষা। তারপর শিক্ষা পায় সামাজিক পরিবেশ এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে।
একজন প্রকৃত শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত নৈতিক শিক্ষা দেন, যা তাকে মূল্যবোধ তৈরি করতে সহায়তা করে। আবার অতি আদরের নামে সন্তানের আবদার রাখতে গিয়ে এমন কিছু জিনিস তাদের দিয়ে দেয়া হয় যা তাকে খারাপ পথের দিকে ধাবিত করে। এছাড়া রুচিশীল ও ভদ্রোচিত পোশাক পরা এসব বিষয়েও সন্তানদের কোনো আদেশ, উপদেশ বা কাউন্সিলিংয়ের অভাব রয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক অভিভাবকের আচরণে এমন ভাব পরিলক্ষিত হয় যেন ছেলেমেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল বন্ধু যত বেশি হতে পারে ততই তা গর্বের বিষয়। এ সময়ের কিশোর-তরুণদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে বলে মনে হয়। তবে এখন বুক বা বই পড়ছে ঠিকই তবে তা ফেসবুক।
প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখন শিশু-কিশোরদের আগের মতো আর মাঠে খেলা করতে দেখা যায় না, পার্কে বিনোদনের জন্য যায় না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যায় না কিংবা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করার সৌজন্যও দেখা যায় কম। এখন সব যেন ফেসবুকে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখালেখিতে যন্ত্র ও যান্ত্রিকতার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে গেছেন। তিনি যন্ত্রকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন কিন্তু যান্ত্রিক জীবনকে ঘৃণা করেছেন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, বøগ, ইউটিউবের মতো গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই এসব গণমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে।
বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশু অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার ও সংশোধনের জন্য পৃথক আদালত ও সংশোধনাগার আছে। শিশুদের বয়স বিবেচনায় নিয়ে শিশু ও কিশোর অপরাধের বিচার ও সংশোধন করার জন্য এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচারব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশু নীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এরপর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটি প্রধান। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরও পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে।
বাংলাদেশ মূলত ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে শিশু বা কিশোর অপরাধ ও বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দেয়। অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে কিশোর অপরাধের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। দরিদ্র ও সম্পদের প্রাচুর্য উভয়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কিশোর অপরাধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দারিদ্র্যতার কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে কিশোররা বিভিন্ন প্রকারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিশোর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পারিপার্শিক সামাজিক পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম বিধায় আবাসিক পরিবেশ, সঙ্গীদের প্রভাব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি সামাজিক উপাদানগুলো শিশু-কিশোরদের আচরণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো পরিবার।
জন্মের পর শিশু পারিবারিক পরিবেশ মাতা-পিতার সংস্পর্শে আসে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিবারের বয়োজেষ্ঠ কেউ অপরাধপ্রবণতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে শিশু-কিশোররাও তাতে প্রভাবিত হয়। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরিবার, সমাজের মুরব্বি, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়াসহ প্রত্যেকের সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন