কিশোর অপরাধ আমাদের সমাজে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পিতামাতা বা অভিভাবকদের উদাসীনতা-অবহেলা অথবা সন্তানদের প্রতি অধিক ভালোবাসা তাদের অনেককে বেপরোয়া করে তোলে। আকাশ সংস্কৃতি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণেও শিশু-কিশোর-তরুণরা প্রভাবিত হচ্ছে। আগরেকার দিনে মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনেকে ভোর হওয়ার সাথে সাথে মসজিদ-মকতবে চলে যেতো এবং মকতবে দ্বীনী পড়া শেষ করে সকাল দশটার দিকে স্কুলে যেতো। কিন্তু এখন সে যুগ বাসি হয়ে গেছে। করোনা মহামারির আগপর্যন্ত শিশুদের এক গাদা বই খাতা বগল দাবা করে স্কুলে ছুটতে গেখা গেছে। এখন করোনাকালে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নানা কিসিমের দামী মোবাইল ফোন। গৃহে সারাক্ষণ তারা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
চারিত্রিক গুণাবলী তথা নৈতিকতা মানব জীবনের অপূর্ব সৌন্দর্য, যা ইসলামেরও মহান শিক্ষা। এ নৈতিকতা বিবর্জিত জীবন ধ্বংসের মূল কারণসমূহের অন্যতম। আরবি ‘খুলকুন’ অর্থ চরিত্র বা নৈতিকতা। বহু বচনে বলা হয়, আখলাক। এর বিপরীত রয়েছে বদ আখলাক বা দুশ্চরিত্র, কুস্বভাব ইত্যাদি। আমাদের মন্দ স্বভাব ও কুচরিত্রের সঠিক তালিকা নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার। তবে বিভিন্ন আঙ্গিকে কোরআন ও হাদীসের আলোকে মাশায়েখ উলামায়ে কেরাম বদ চরিত্রগুলোর এক বিশাল তালিকা প্রস্তুত করলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। এ সব কুস্বভাব ও মন্দ স্বভাব মানব জীবনকে কীভাবে কলুষিত ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যাবলী ও তৎপরতাগুলো আলোচনা করলে সহজে অনুমান করা যায়। উত্তম ও ভালো চরিত্রের স্থলে মন্দ চরিত্র আমাদের জীবনকে কী ভয়ানকভাবে গ্রাস করে চলছে, তার দৃষ্টান্ত পদে পদে লক্ষ করা যায়। শুরুতেই উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি মন্দ স্বভাব বা চরিত্রের নাম উল্লেখ করা যায়।
সন্তান পিতামাতা বা অভিভাবকদের অবাধ্য ও অপরাধী হয় কেন? সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাওয়ার আতঙ্কজনক ঘটনাবলী ও খবরাখবরের কারণে জনমনে এরূপ প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে। এর সঠিক জবাব দিতে হলে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির বিচার বিশ্লেষণ করা সময়ের তাকিদ হয়ে দেখা দিয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী-চিন্তাবিদ তথা সমাজ ও জাতীয় পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীজনের অভিমত, এ মারাত্মক সর্বনাশা সমস্যার উৎপত্তি স্থল পরিবার এবং পরিবারই পারে এর সুষ্ঠু সমাধান দিতে। সন্তান বলতে পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশই বুঝায়। আর পরিবারের নেতৃত্বে যারা থাকেন, তারা হচ্ছেন প্রথমে পিতা, অতঃপর স্বামী-স্ত্রী ও অন্যরা। সন্তাননের বেড়ে উঠার নির্দিষ্ট বয়স তথা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত শৈশব ও কৈশোর সাধারণত পিতামাতা তথা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কেটে যায়। তবে মাতাপিতাহীন এতিম শিশু সন্তানদের অভিভাবক হিসেবে এগিয়ে আসেন আপন স্বজন ও সমাজের গণ্যমান্য শুভানুধায়ীগণ।
নেক বা সৎ সন্তানকে হাদীসে ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে হজরত আবু হোরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘মানুষ যখন মৃত্যু বরণ করে, তখন তার আমল-কর্মেরও সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তিন প্রকারের এমন আমল রেখে যায় সেগুলোর সাওয়াব মৃত্যুর পরও পেতে থাকে। একটি হচ্ছে সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম রেখে যায় যা দ্বারা লোক উপকার ভোগ করে এবং এমন সুসন্তান রেখে যায় যে তার জন্য দোআ করে।’ (মুসলিম)
‘সাদকায়ে জারিয়া’ বলতে সে সাদকাকে বুঝায় যার ফায়দা বা উপকার দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেমন, নদী, খাল, কূপ, পুকুর খনন কিংবা মোসাফিরদের জন্য সরাই খানা নির্মাণ অথবা রাস্তায় গাছ লাগানো, কিংবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কিতাব-বই পুস্তক ওয়াকফ করা ইত্যাদি কর্ম দ্বারা লোক যত দিন উপকৃত হতে থাকবে, কর্ম সম্পাদনকারীও তার সেই কাজের সাওয়াব লাভ করতে থাকবে। অনুরূপ কেউ যদি কোনো লোককে শিক্ষাদান করে যায়, তারও সওয়াব সে পাবে। সাদকায়ে জারিয়ার এ ধরনের অসংখ্য দিক রয়েছে। আবার এর বিপরীত দিকও রয়েছে অনেক। হিংসা, মিথ্যা অভ্যাস, মিথ্যা শপথ, অঙ্গীকার ভঙ্গ, খেয়ানত, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা, অপবাদ, চুগুলখোরি, পরনিন্দা, মন্দ ধারণা, কৃপণতা, লোভ-লালসা, বেইমানি, চুরি, গোপনে লওয়া, ঘুষ, সুদখোরি, মদ্যপান, অন্যায় রাগ, হিংসা পরায়নতা, জুলুম-নির্যাতন, গর্ব-অহংকার, গালমন্দ ইত্যাদির পরিণতি অত্যন্ত মারাত্মক। এসব হচ্ছে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রকাশ্য লক্ষণ। এগুলোর সাথে যুক্ত হয়, পিতামাতার প্রতি সন্তানের অবাধ্যতা এবং সন্তানের প্রতি মাতাপিতা বা অভিভাবকদের উদাসীনতা ও অবহেলা। এরই ফলে দেশের নানা স্থানে দেখা দিয়েছে কিশোর গ্যাং বা অপরাধী চক্রের বিষাক্ত ছোবল।
পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তানের সম্পর্কে কোরআনের বহু আয়াতে এবং অসংখ্য হাদীসে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পিতামাতার সাথে উত্তম আচরণ প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে অন্তত ১২টি বিভিন্ন আয়াত নাজেল হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্র শিক্ষা, তওহীদ এবং আল্লাহর এবাদত বন্দেগীর বর্ণনার পর এ সব আয়াত এসেছে। বহু আয়াতে পিতামাতা বিশেষভাবে মায়ের খেদমত ও অনুসরণ এবং তার সন্তুষ্টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সূরা তাহরীমের আয়াতে সন্তানের জাহেরী ও শারীরিক লালন পালনের পর বাতেনী ও আধ্যাত্মিকতার কথা বলা হয়েছে। আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেকে এবং নিজেদের পরিবারবর্গকে আগুন হতে রক্ষা কর।’ জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করার দায়িত্ব পরিবার প্রধানের। এ আগুন দ্বারা সকল মন্দ, খারাবি এবং ধ্বংসযজ্ঞ হতে পরিবারবর্গের নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। ওসব কাজই মানুষকে অপরাধের দিকে ধাবিত করে। আয়াতে ‘তোমাদের আহাল’ বলতে সন্তানাদি ও পরিবারবর্গকে বুঝানো হয়েছে। এই মর্মে একটি হাদীসে বলা হয়েছে: ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমাদের প্রত্যেককে প্রশ্ন করা হবে।’
বিশেষত সন্তানের মাতাপিতার এ সময়ের দায়িত্বের কথা রসূলুল্লাহ (সা.) স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন: ‘প্রত্যেক সন্তান স্বভাবধর্মের ওপর (ইসলামের ওপর) জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার বাবামা তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় এবং মজুসী (অগ্নি উপাসক) বানায়।’ অর্থাৎ সন্তানের শৈশবকালে তার বাবামার যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল, সে দায়িত্ব পালনে তাদের অগ্রণী ভূমিকা থাকার কথা থাকলেও, তা পালনে তাদের ব্যর্থতাই সন্তানকে বিপথগামী করে। কেননা সন্তানের এ মাসুম বয়সে মাতাপিতার অবহেলা ও অসতর্কতাই তার বিপথগামী হবার জন্য দায়ী। এ জন্য খোদার দরবারে তাদের জবাবদেহি হতে হবে। দায়িত্বের কথা এবং একই সঙ্গে সমাজপতিদের কথাও আসে। সন্তানের শৈশব পার হবার সাথে কৈশোরকালের সূচনা। এ সময় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবনও শুরু হয়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সে বাবামার কাছ থেকে কিছু সময়ের জন্য ওস্তাদের সান্নিধ্যে চলে যায় এবং সহপাঠি ও পরিবেশের প্রভাব সে গ্রহণ করতে থাকে। এটি তার চরিত্র গঠনের উপযুক্ত সময়। ওস্তাদের নজরদারিতে অবহেলা-অসচেতনতা কৈশোর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।
রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি হেফাজতকারী, রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং তোমাদের মধ্যে হতে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করা হবে। সেসব লোক সম্পর্কে যারা তোমাদের নিরাপত্তায় থাকবে। আমির (শাসক) ও নিরাপত্তা দানকারী তাকে ও তার প্রজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে এবং স্বামী তার পরিবারের রক্ষক এবং স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানদের রক্ষক এবং চাকর তার মালিকের মাল মাত্তার রক্ষক। অতএব, তোমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই রক্ষক। কাজেই তোমাদের মধ্য হতে প্রত্যেকের নিকট সেসব লোক সম্পর্কে জিজ্ঞিাসা করা হবে, যাদেরকে তার দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
এ হাদীসের প্রতিটি অংশ বিচার বিশ্লেষণযোগ্য। তবে বিশেষভাবে এই অংশটি স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের ও তার সন্তানদের রক্ষক, একথা প্রমাণ করে যে, স্বামী তার স্ত্রীর কেবল খোরপোশের জিম্মাদার নয়, তার দ্বীন ও চরিত্র রক্ষারও জিম্মাদার এবং স্ত্রীর দায়িত্ব ডবল। সে তার স্বামীর পরিবারের মাল সামানের দেখ-ভালের পাশাপাশি তার সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষার প্রতি ও বিশেষ দায়িত্ব পালন করবে। কেননা, স্বামীকে জীবিকা অর্জনের স্বার্থে অধিকাংশ সময় বাইরে থাকতে হয় এবং গৃহে সন্তানরা তাদের মায়ের অধিক প্রিয় হয়। সুতরাং সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব মায়েদের ওপর বর্তায়।
কোনো বাবামায়ের সুসন্তান থাকাটা তাদের জন্য আল্লাহর বড় নেয়ামত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে এমন দুঃখজনক ঘটনার খবরও মাঝে-মধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখা যায় যে, অবাধ্য পুত্রের হাতে পিতা বা মাতা খুন হয়েছে। ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, চাচা-ভাতিজার খুনাখুনি, স্বামী-স্ত্রীর খুনাখুনি ইত্যাদি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এমনও দেখা যায়, ছেলে নেশাখোর। বাবামায়ের কাছে নেশার খরচ চেয়ে না পেলে, তার প্রতিশোধ নেয় হত্যার মতো মহা পাপকার্য সমাধা করে। এ জাতীয় খুনের ঘটনাবলীর মূল কারণ শৈশব-কৈশোর কাল থেকে ছেলেমেয়ের প্রতি নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং সুশাসনের অভাব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন