দলে তারুণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আপাতত মনে হচ্ছে এরা ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলেছেন। দলকে জেতাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে দরকার পরীক্ষিত পারফরমার। সাকিব-মুস্তাফিজ-মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক আর কোনো বড় নাম নেই। তাই বিশ্বকাপে বিপন্নতা আসলে ত্রাতা হিসেবে এদের কাউকে আবির্ভূত হতে হবে। তামিমের বিশ্বকাপ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত যুক্তি-তর্কে সঠিক বলা যাবে। তিনি নিজে তার সিদ্ধান্তের একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। কিন্তু তার পরও মনে হয়, দলের ভেতরে কোথাও একটা তাল কেটে যাওয়ার আওয়াজ! আপাতত দলীয় সাফল্য সেটা হয়তো সেভাবে সামনে আসছে না। ভয়ডরহীন ক্রিকেটে সেই ছন্দ খুঁজে পেলেই মিলবে সাফল্য
টানা তিনটা সিরিজ জয়। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। আর সংখ্যাতত্ত্বে তিন সিরিজের চেহারা ২-১, ৪-১ এবং ৩-২। এ রকম একটা পরিসংখ্যান পেছনে রেখে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে দাপট দেখিয়ে সিরিজ জয়ের পরও বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কিন্তু সেই নিম্নবিত্ত প্রতিনিধি! সরাসরি নয়, ওমানে বাছাই পর্ব খেলে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার ভিসা নিতে হবে মাহমুদউল্লাহ, সাকিবদের। কারণ বিশ্বকাপের সূচি আর গ্রুপিং ঠিক করার সময় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সঙ্গী ছিল দীনতা। সরাসরি বিশ্বকাপের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ার মতো অবস্থা তার ছিল না।
ক্রিকেটে ‘জয়’ যদি হয় আত্মবিশ্বাসের আধার, তা হলে মরুর বুকে সেটা ভরপুর থাকার কথা বাংলাদেশের। ব্যাকফুটে নয়, ফ্রন্টফুটে গিয়েও পুল খেলার সাহস দেখাতে পারে বাংলাদেশ। কারণ অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মতো ক্রিকেটীয় শক্তিকে বিধ্বস্ত করে অবিমিশ্র আনন্দ সরণি দিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে গেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু বিশ্বকাপের ক্রিজে তাকে নতুন করে স্ট্যান্স নিতে হবে। পেছনের কোনো সংখ্যা-টংখ্যা স্কোরবোর্ডে থাকবে না। নিজেদের দেশে তাসমানপারের দুই ক্রিকেটীয় পরাশক্তিকে বিধ্বস্ত করার কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে হবে পারফরম্যান্স দিয়ে। সে কারণে চাপটা অনেক বেশি থাকবে। থাকবে প্রত্যাশাও। তাই ব্যাটসম্যানরা যেমন মাথা নিশ্চল করে বলের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তেমনিভাবে বাংলাদেশ দলকে বিশ্বকাপের দিকে তাকাতে হবে। না হলে প্রত্যাশার চাপ উড়িয়ে দিতে পারে স্টাম্প। কিংবা ‘এজ’ নিয়ে ‘জয়’ চলে যেতে পারে প্রতিপক্ষের হাতে। বিশ্বকাপের ক্রিকেটীয় রাজসভায় যোগ দিতে যাওয়ার সময় একটা ভয়ও সঙ্গী বাংলাদেশের। নিজেদের মাঠে যাদের প্রায় বিবস্ত্র করল, তারা কিন্তু মুখিয়ে আছে বাংলাদেশকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার জন্য।
আসলে বড় সমস্যায় বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা। এই যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়কে বলা হচ্ছে, ঘরের মাঠে মন্থর উইকেটে এভাবে ম্যাচ জিতে কোনো লাভ নেই! আবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাদের মাঠে সিরিজ জয়, সেটাকেও একটু খাটো করার চেষ্টা। বলা হয়েছে, জিম্বাবুয়ে দল তো এখন ক্লাব দলের চেয়েও খারাপ! আবার না জিততে পারলে বলা হতো; জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও জিততে পারে না! তা হলে ক্রিকেটারদের অমানসিক পরিশ্রম, থিঙ্কট্যাঙ্কের হোমওয়ার্ক এসবের কি কোনো মূল্য নেই!
আছে। যদি আপনি বিশ্বকাপে ভালো কিছু করে দেখাতে পারেন। কারণ বিশ্বকাপে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখগুলো সব এক জায়গায় ফোকাস থাকে। আপনি বা আপনারা কী করলেন, সেটা বিশ্বগণমাধ্যমেও বড় খবর হয়ে উঠে আসে। আর সত্যি কথা হচ্ছে, ঢাকার মাঠে যে উইকেটে খেলা হয়েছে, তা নিয়ে তো প্রশ্ন আছে। ওটা ঠিক আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির জন্য উপযুক্ত সেই সার্টিফিকেট দেওয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন দল জিতেছে কিংবা কারা হেরেছে সেটা ভুলে যান। যেখানে টানা দশটা ম্যাচে ১৫০-এর বেশি রান উঠেছে মাত্র এক ইনিংসে সেটাকে আর যাই হোক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য ভালো উইকেট কেউ বলবেন না। বিশ্বকাপের উইকেটের ডিজাইন ভিন্নই হবে। রান। রান। আর রান চাইবেন সবাই। সেটা ক্রিকেটাররা যেমন চাইবেন। তেমনি চাইবেন দর্শকরা। আর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যারা খরচ করবেন সেই স্পন্সররাও চাইবেন। তাই একশ চল্লিশ-পঞ্চাশ রান করে ম্যাচ জেতা যাবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট হচ্ছে রক অ্যান্ড রোল সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্তু ঢাকায় যা দেখা গেল সেটা অষ্টাদশ শতাব্দীর উচ্চাঙ্গসংগীত শিক্ষার আসর! এই যে নিউজল্যিান্ড টিমে রাচিন বরীন্দ্র নামে এক ক্রিকেটার খেলে গেলেন, তিনি বুঝে গেলেন, রবীন্দ্রনাথ আরেকজন ব্যক্তি এই দেশটার জাতীয় সংগীত লিখেছিলেন, সেটাও খানিকটা নতুনভাবে কম্পোজ করে গাওয়া হয়। যেখানে লয়টা একটু ফাস্ট। কিন্তু মিরপুরের উইকেট, সেটা আগের চেয়েও সেøা! এখানে টি-টোয়েন্টির স্ট্রোক প্লে আশা না করাই ভালো।
অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড দুদলের ক্রিকেট কর্তারাই আভাসটা মনে হয় আগেই পেয়েছিলেন, কেমন হতে পারে মিরপুরে উইকেট। তাই তারাও একটা পেশাদারি চাল দিয়ে রেখেছিলেন। স্কোরকার্ডে সেটা অবশ্য অদৃশ্য। ক্রিকেটে নতুন চিন্তার ঘরানায় অস্ট্রেলিয়ানরা সব সময় এগিয়ে। উদ্ভাবনী ক্ষমতায়ও। বিশ্বকাপের আগে হারের আঘাতে গোটা দল রক্তাক্ত হোক সেটা তারা চাননি। তাই স্টিভ স্মিথ-ওয়ার্নার-ম্যাক্সওয়েলদের মতো ক্রিকেটারকে ঢাকায় পাঠাননি। ওরা জানেন, কোন টিম এখন, দলকে আক্রমণ করার আগে সেনাপতিকে গুলি করে ফেলে দিতে চায়। তিনি ঘোড়া থেকে পড়ছে দেখে বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যুদ্ধ জেতা সহজ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ান সেই ফরমুলা অন্যভাবে প্রয়োগ করল নিউজিল্যান্ড। নিজেদের অধিনায়ককে তারা আগলে রাখলেন। যুদ্ধেই পাঠালেন না। সঙ্গে প্রথম সারির যোদ্ধাদেরও। কেন উইলিয়ামসন, ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, কাউকেই বাংলাদেশ সফরে পাঠায়নি ক্রিকেট নিউজিল্যান্ড। সেনাপতি এবং সামনের সারির অন্য যোদ্ধাদের রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে হয়নি তাদের। তাই বিশ্বকাপে তারা পুরো গোলাবারুদসহ যুদ্ধে নামতে পারবেন। হারক্লিষ্ট মন নিয়ে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছে না। তাই নিজেদের মাঠে দারুণ সিরিজ জয়ের পরও বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কিন্তু কাঁটা বিছানো শয্যাই পাবে।
তবে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের দারুণ জয় নিয়েও কিছু কাটাছেঁড়া হবে এবং হচ্ছে। এগুলো শুনতে রুক্ষ-কর্কশ শোনালেও কথাগুলো শোনার অভ্যাস থাকা ভালো। প্রথমত, প্রতিটি দেশ তাদের নিজের মতো উইকেট বানাতে চাইবে। সেখান থেকে কিছু বাড়তি সহায়তা যাতে হোম টিম পেতে পারে। বাংলাদেশও তাই করেছে। তাতে ক্রিকেটীয় আইনে অন্যায় কিছু হয়নি। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণাও করা হয়েছে। দর্শকরা রান দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা দেখলেন কোথায়? ব্যর্থতাটা ব্যাটসম্যানদের নয়। যারা এ রকম উইকেট বানানোর প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন তাদের। আপাতত এই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে রোগ ভালো হলো বটে। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার শঙ্কা কিন্তু থাকছে। বিশ্বকাপ বা পরে দেশের বাইরের সিরিজগুলোতে কী আর এই উইকেট পাওয়া যাবে, যেখানে ১৩০ বা ১৪০ করে ম্যাচ জেতা যাবে? বড় রান তাড়া করে জেতার কাজটা কঠিন। সেটা তো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬১ রান তাড়া করতে নেমেই টের পেল বাংলাাদেশ। তাই সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা আগামীতে ফিকে হয়ে গেলে অনেক কথা উঠবে। সেটা সহ্য করার মানসিকতা তৈরি থাকা ভালো।
দলে তারুণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আপাতত মনে হচ্ছে এরা ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলেছেন। দলকে জেতাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে দরকার পরীক্ষিত পারফরমার। সাকিব-মুস্তাফিজ-মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক আর কোনো বড় নাম নেই। তাই বিশ্বকাপে বিপন্নতা আসলে ত্রাতা হিসেবে এদের কাউকে আবির্ভূত হতে হবে। তামিমের বিশ্বকাপ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত যুক্তি-তর্কে সঠিক বলা যাবে। তিনি নিজে তার সিদ্ধান্তের একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। কিন্তু তার পরও মনে হয়, দলের ভেতরে কোথাও একটা তাল কেটে যাওয়ার আওয়াজ! আপাতত দলীয় সাফল্য সেটা হয়তো সেভাবে সামনে আসছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে গণমাধ্যমে তেমন আভাস। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো দলের কিংপিংকে করবেন সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। উত্তরটা খুব গোছানো ছিল। প্রথম দুই ম্যাচে নুরুল হাসান সোহান। পরের দুই ম্যাচে মুশফিক। পঞ্চম ম্যাচে সিদ্ধান্ত হবে এই দুজনের পারফরম্যান্স দেখে। কিন্তু মুশফিক টি-টোয়েন্টিতে আর কিপিং করতে চান না বলে জানালেন! তার আগে তামিম সরে দাঁড়ালেন! এসব সিদ্ধান্ত কী তাদের দল থেকে বাদ পড়ার শঙ্কা থেকে না কী এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে এ রকম সিদ্ধান্ত না নিয়ে তাদের উপায় ছিল না!
কারণ যাই হোক। যে কাজে সমস্যা নেই, সেটা কোনো কাজ নয়। আর সাহস বাদ দিয়ে জীবনে কোনো কিছু হয় না। আত্মমর্যাদাকে বাদ দিয়ে শুধু মানসিক জোরকে মোটিভেশন কার্ডে রাখলে হয় না। তবে তামিম-মুশফিকরা শঙ্কার আগে নিজেদের পেশাদারিত্বের আত্মমর্যাদাকে নিশ্চয়ই আগে রেখেছেন যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে।
দলের ভেতরে যাই হোক, সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স যথেষ্ট উজ্জ্বল। তবে মরুর বুকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দাবি কতটা, অতীত দেখে তা বলা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করার চেয়ে মূর্খতা ক্রিকেট অভিধানে আর কিছু নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন